প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয়’ ১৬ – হারিয়ে যাচ্ছে ছনের ঘর!! # আকরাম উদ্দিন আহমেদ ।।

 প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয়’ ১৬ –

হারিয়ে যাচ্ছে ছনের ঘর!!

# আকরাম উদ্দিন আহমেদ ।



বাংলাদেশের বিশেষ করে উত্তর অঞ্চলে ছন বা খড়ের তৈরী ঘরের দৃশ্য বেশীকাল আগের নয়। আধুনিকতার ছোয়াঁয় বর্তমানে ছনের তৈরী ঘর আর নেই বললেই চলে।

দিন দিন ছন বা খড়ের ছাউনির ঘরের প্রচলন কমে আসছে। হারিয়ে যেতে বসেছে আবহমান কালের গ্রামবাংলার চিরচেনা গ্রামীণ ঐতিহ্য ছনের ঘর। তবে রূপকথার গল্পের মতো আগামী প্রজন্মের কাছে হয়তো নাড়া দেবে, যেখানে প্রতিটি গ্রামে একাধিক ছনের তৈরি ঘর চোখে পড়ত, সেখানে বর্তমানে কয়েকটি ইউনিয়ন মিলেও একটি ছনের ঘর চোখে পড়ে না।

আধুনিকযুগে টিনের সহজলভ্যতা এবং স্থায়িত্ব এর ব‍্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছে। অপর দিকে টিনের ঘর প্রতিবছর মেরামত করতে হয়না বলে তা স্বাশ্রয়ী। তবে টিনের অত্যাধিক ব্যবহারের ফলে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। কারণ দেশে উৎপাদিত অধিকাংশ টিন পরিবেশবান্ধব নয়। তথাপি গ্রামগঞ্জে এখনো কিছু ছনের বা খড়ের ঘর চোখে পড়ে।

দুই যুগ আগেও গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ছনের ছাউনি করা ঘর ছিল। ছন বা খড় মুলত ব্যবহার করা হতো ঘরের ছাউনি দেয়ার কাজে। নিন্ম বিত্তের মানুষ এটি দিয়ে ঘরের ছাউনি দিত। এ ছাড়া চর অঞ্চলের লোকেরা এই ছন বা খড় বিক্রি করে সংসার চালাত। স্থানীয়ভাবে গরীবের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর বলে পরিচিত ছিল এই ছনের ছাউনি করা ঘর। উচ্চবিত্তরাও শখের বসে পাকা ঘরের চিলে কোঠায় ছন ব্যবহার করত।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে আমাদের বাড়ির বিপরীত দিকে মকবুল খাঁন সাহেব নামে এক সৌখিন ভদ্রলোক লোক বাস করতেন। উনি পশ্চিমবঙ্গের রাণাঘাটে ছনের ছাউনি দেয়া পাকা ঘর দেখে এসেছিলেন। তিনি ঐ আদলে বাড়িতে দুটি উঁচু বড়সর রকমের ইটের গাথুনি দেয়া পাকা ঘর তৈরী করে ফেলেন এবং ঘরের ছাউনি খড় দিয়ে সেরে ফেলেন। আমরা লক্ষ্য করেছিলাম তার খড়ের ছাউনি দেয়া বৈঠক খানা এবং শয়ন কক্ষটি গরমের দীনে এবং শীতের দিনে বেশ আরাম দায়ক ছিল।

আদতে পল্লী অঞ্চলে এই ছনের ঘর শীত ও গরম উভয় মৌসুমে আরামদায়ক হয়ে থাকে। ছনের ছাউনির ঘর তৈরির জন্য গ্রামে বিশেষ কিছু কারিগর ছিল। তাদের মজুরিও ছিল স্পেশাল। বিশেষ কায়দায় ছনকে সাজিয়ে কয়েকটি ধাপের মাধ্যমে ছাউনি দেয়া হতো। ছাউনির উপরে বাঁশ ও বেত দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিয়ে পানি ছিটানো হতো যাতে করে সহজে ছনগুলো বাঁশের ওপর বসে যায়। ঘরের বেড়া বাঁশের চাটাই অথবা মাটি দিয়ে বানানো হত। সাধারণত বন্যা, ভূমিকম্প, ঝড় কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এসব ঘর বছরের পর বছর পর্যন্ত টিকে থাকতো। শুধু দুতিন বছর পর পর একটু মেরামত করে নিলেই হল।

তবে পূর্বপুরুষের স্মৃতি ধরে রাখতে অনেকেই দু-একটা দৃষ্টিনন্দন ছনের ঘর অদ‍‍্যবধি টিকিয়ে রেখেছেন। চোর-ডাকাতের ভয়ে মানুষ ক্রমশ মাটি ও ছনের ঘর তৈরীতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।অপরদিকে গ্রামেগঞ্জে আধুনিকতার ছোঁয়া এসে লাগে। শুরু হয় পাকা দেয়াল, টিনের বেড়া ও ছাউনি দিয়ে ঘর তৈরীর রেওয়াজ। এ ছাড়া প্রায় প্রতি বছর ছন পরিবর্তন করতে হয় বলে একে অনেকে ঝামেলা ও ব‍্যয়বহুল মনে করেন। সেই থেকে ছনের ছাউনি ঘরের সংখ্যা কমতে শুরু করে। বর্তমানে এই ঘর খুব একটা চোখে পড়ে না। মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে জীবন মানের ও উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। আর তাই হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙ্গালীদের চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী এই ছনের ঘর।

হয়তো সে দিনটি খুব বেশি দূরে নয় যে দিন ছনের ছাউনির ঘরের কথা মানুষের মন থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। আর আগামী প্রজন্মের কাছে তা হয়ে থাকবে এক রূপকথার গল্প।



আকরাম উদ্দিন আহমেদ
লেখক
কুড়িগ্রাম।
২৩/১০/২০২১।


হ্যালো জনতা ডট কম ।।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কবি-রবি ডাকুয়ার বিজয় দিবসের কবিতা ‘বিজয়ের জন্যে’।।

তাল বা খেজুর রসের বিকল্প, গোলফল দিয়ে হতে পারে রস গুড়-রবি ডাকুয়া ।।

কেন আমাদের এমন মাথা নিচু ছবি দেখতে হবে ? মুসা কামাল-সম্পাদক- হ্যালো জনতা .কম ।।