বৈমানিকের পাণ্ডুলিপি ।। ৩১ ।। বৃষ্টি ভেজা লাক্সেমবার্গ। রেহমান রুদ্র।।

 

বৈমানিকের পাণ্ডুলিপি ।। ৩১ ।। 

বৃষ্টি ভেজা লাক্সেমবার্গ। 

রেহমান রুদ্র।।


বেশ কিছুদিন পর আবারো এলাম লাক্সেমবার্গ। ইউরোপের এই পাহাড়ি শহরে বিকেল এলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নিয়ে। ছোট্ট এ দেশটিকে ঘিরে আছে বেলজিয়াম ফ্রান্স আর জার্মানি। পাঁচ লক্ষের মত মানুষের আবাসভুমি। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা এ দেশটিকে তাদের দখলে রেখেছিল। বর্তমানে লাক্সেমবার্গ ইউরোপের পাওয়ারফুল ইনভেস্টম্যান্ট ম্যানেজম্যান্ট সেন্টার। এয়ারপোর্টের রানওয়েতে বেশকিছু বিজনেস জেট পার্ক করা দেখে বিষয়টি সহজেই অনুমান করা যায়।

ল্যান্ডিং করার সময় বৃষ্টির ফোয়ারা এয়ারক্রাফটকে বিনা খরচে ধুয়ে দিল। পাহাড়ি এলাকা হবার কারনে রানওয়ে পুরোটা সমতল করে বানাতে পারেনি। উঁচুনিচু হবার জন্য পাইলটকে দক্ষতার সাথে বিমানকে টাচডাউন করাতে হয়। ভূমি স্পর্শ করার পরপর ককপিট থেকে সামনে দেখলে মনে হবে হটাত করে রানওয়ে বুঝি শেষ হয়ে গেল। হাম্প এর কারনে সামনে কিছু দেখা যায়না। এটা পাইলটের জন্য অস্বাভাবিক একটি বিষয়। বিমান তার গতি নিয়ে ল্যান্ড করার পরে যদি পাইলট তার দিব্যদৃষ্টিতে সামনে দেখতে না পায় তখন তার ফিলিং কি হয় তা পাইলটের পক্ষেই বলা সম্ভব। ঐ উঁচুভাগ ক্রস করার পরে রানওয়ে আবার ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। বৃষ্টি হলে রানওয়ে স্বাভাবিকভাবেই পিচ্ছিল হয়ে পড়ে। মুহূর্তেই পাইলটকে বিমানের গতি নিয়ন্ত্রণে আনার সব ধরনের টেকনিক অবলম্বন করতে হয়। বিষয়টা বেশ ট্রিকি। যতদূর সম্ভব সহজভাবে বলার চেষ্টা করেছি।

সন্ধ্যেটা কাজে লাগানোর জন্য বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলাম। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা তার সাথে বৃষ্টির মাখামাখিতে জ্যাকেট ভিজে একাকার। মুখের উপরে মনে হল কেউ যেন বরফ শীতল পানি দিয়ে স্প্রে করছে। তাপমাত্রা পাচ কি ছয় ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। মেইন রোডে উঠে দশমিনিট হেটে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। মনের ভেতরের মেমোরি থেকে আমেরিকান কান্ট্রি সিঙ্গার বিলি জো থমাসের গান “রেইন ড্রপ কিপ ফলিং অন মাই হেড” গানটি গুনগুন করছে। বিখ্যাত এ গায়ক এ বছর মে মাসে ৭৮ বছর বয়সে ক্যান্সারে পরাজিত হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। নিজ আবাসভূমি আরলিংটন, টেক্সাস, আমেরিকাতেই তার মৃত্যু হয়।

আমার দেখা মতে এদেশের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম সম্ভবত সেরা ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন আর অনডট টাইম ম্যানেজমেন্ট। আরামদায়ক সিটের সাথে বাচ্চাদের ট্রলি কিংবা হুইল চেয়ার নিয়ে উঠার ব্যবস্থা করা আছে। যেসব যাত্রী দাড়িয়ে যাবে তাদের জন্য হিপ ও কোমর বরাবর ঢালু করে ওয়ালের সাথে কুশন এঁটে দেয়া আছে। এক কথায় কমফোর্টেবল রাইড। বাসস্টপে ইলেকট্রনিক সাইনবোর্ড। বিভিন্ন বাস নাম্বার ও গন্তব্যের ম্যাপিং দেয়া আছে। তবে অক্ষরগুলো লোকাল ল্যাংগুয়েজে লিখা। এয়ারপোর্ট কিংবা ট্রেন ষ্টেশনের মত বাসের অবস্থান জানা যায়। এ সিটিতে নতুন হবার কারনে সঠিক পথে যাচ্ছি কিনা তা ডাবল চেক করতে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলে সে উত্তরে মাথা উচুনিচু করাতে বুঝতে পারলাম সব ঠিক আছে। এখানে ইংরেজি ভাষায় খুব কম সংখ্যক মানুষ কথা বলে। লাক্সেমবারগিশ, ফ্রেঞ্চ আর জার্মান ভাষা কমন বলা যায়।


লাক্সেমবার্গ সেন্ট্রালের দিকেই যাচ্ছিলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৪০০ ফুট উঁচুতে শহরটি দাঁড়িয়ে আছে। একটা বিষয় খেয়াল করলাম, বেশিরভাগ রাস্তা বানানো হয়েছে বাড়িঘরের উচ্চতার উপরে। এতে করে শব্দ দূষণ কমে যাবে। পৃথিবীর বেশিরভার দেশেই এখন শব্দ দূষণ নিয়ে নাগরিক অধিকারকে সম্মান দেখানো হচ্ছে। আইন অমান্য করলে প্রচুর ফাইন দিতে হয়। ইউরোপের দেশগুলো অত্যন্ত কঠোরভাবে নিয়ম মেনে চলে।

সেন্ট্রাল ষ্টেশনে নেমে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালাম। বেশকিছু আফ্রিকান মানুষ চোখে পড়ল। টার্কিশ ডোনার কাবাব রেস্টুরেন্টে ভিড়। ওয়েস্টার্ন গ্রিল, স্টেইক হাউজ আর জাপানিজ রেস্টুরেন্ট দেখতে পেলাম। টার্কিশ রেস্টুরেন্টে বড় করে লিখা ”হালাল”। ঠাণ্ডায় জমে যাবার আগে টার্কিশে ঢুকে গেলাম।

আহ, কি কমফোর্টেবল টেম্পারেচার সেট করা। বসার যায়গা পেলাম না। অপেক্ষা করতে হবে। সব টেবিল কাস্টমারে ফুল হয়ে আছে। ফুড অর্ডার সেকশনে লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ডোনার কাবাবে ফুল চিকেন ব্রেস্ট অর্ডার দিলাম। ফ্রেস চিকেন পিস নিয়ে নিমিষেই কিমা করে তার সাথে পুদিনা পাতা আর পেঁয়াজ কুচি মিশিয়ে বড় হট প্লেইটে দিয়ে ভাজাভাজা করে ফেললো। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি, ঠাণ্ডা আবহাওয়াতে এধরনের খাবার প্রিপারেশনে সুগন্ধিটা বেড়ে যায়। চিকেন ভাজা হয়ে গেলে পিটা ব্রেড গরম করে ওর মধ্যে ছড়িয়ে দিল। তার উপরে কুচিকুচি ধনেপাতা হট সস আর গারলিক সস দিয়ে কাগজ দিয়ে র‍্যাপ করে দিল সাথে অনেকগুলো ভাজা ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস। ডোনার কাবাবের সাইজ দেখে মনে হল একজনের জন্য যথেষ্ট।

আফ্রিকান ছেলেরা রাস্তায় এদিকওদিক দাড়িয়ে আছে। মনে হয় ইভনিং মিটিং টাইম। এক কথায় আড্ডাবাজি। অফিস ফেরত মেয়েরা বেশিরভাগ প্রসাধন সামগ্রী কিনতে ব্যস্ত। বৃষ্টি কিছুক্ষনের জন্য বিরতি দিয়েছে। এমনিতে পুরোটা ভিজে গেছি। বেশিকিছু দেখা হলনা। ফেরার সময় মেট্রোতে উঠে পড়লাম। ইলেকট্রিক মেট্রো সিস্টেম নানা বর্ণের লাইট দিয়ে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে। মালটি কালার বগিগুলো স্বাপ্নিক আবহ সৃষ্টি করে।

মেট্রো থেকে নেমে হাটার গতি বাড়িয়ে দিতে হল। শরীর গরম রাখতে হলে এটাই একমাত্র অবলম্বন। বৃষ্টি থেমে গেছে কিন্তু মাতাল বাতাসের ঝাপটা শুরু হয়েছে। ভেজা শরীরের ভেতরে গিয়ে বরফের ছুরি কাটছে। দশ মিনিটের পথ বুঝি ফুরায়না। হোটেলের ছাদের উপরে লেখা নিওন সাইনের দিকে চোখ রেখে ক্রমশ এগিয়ে চলেছি। মনের মাঝে এবার ক্রিস ডি বার্গ,

“আই উইশ আই ওয়াজ সেইলিং অ্যাওয়ে…… ।“

রেহমান রুদ্র ।।
# লেখক।।
#প্রবাসী বাঙালি বৈমানিক ।।
# ছবি লেখক প্রদত্ত ।।
# বিধি নিষেধের কারনে অনেক কিছুই লিখতে পারেন না লেখক ।।
সে কারনে লেখক ও হ্যালো জনতা দুঃখ প্রকাশ করছে ।।
# হ্যালো জনতার নিয়মিত লেখক ।।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কবি-রবি ডাকুয়ার বিজয় দিবসের কবিতা ‘বিজয়ের জন্যে’।।

তাল বা খেজুর রসের বিকল্প, গোলফল দিয়ে হতে পারে রস গুড়-রবি ডাকুয়া ।।

কেন আমাদের এমন মাথা নিচু ছবি দেখতে হবে ? মুসা কামাল-সম্পাদক- হ্যালো জনতা .কম ।।