এক্সক্লুসিভ *বৈমানিকের পান্ডুলিপি * ৬ **উত্তর মেরুর ভাবনা ** রেহমান রুদ্র।।



এক্সক্লুসিভ *বৈমানিকের পান্ডুলিপি * ৬ *

*উত্তর মেরুর ভাবনা *

* রেহমান রুদ্র।।

ক্যানাডা থেকে কামরুল ভাই ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন। কোন একটি এয়ারলাইনের পাইলটবৃন্দ সম্প্রতি নর্থপোল ক্রস করেছে। খবরটা মোটামুটি সব মিডিয়াতে প্রচার করছে। ভাল খবর। কামরুল ভাই ও তার পরিবারের সাথে আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব। ওনার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে খুব গুছিয়ে কথা বলেন। অনেক চেষ্টা করেও বাংলা উচ্চারনে কোন ভুল ধরতে পারিনি। সাবলিল বাচনভঙ্গি। ওনার পাঠানো নিউয টি মনের খোরাক জুটিয়ে দিল। ভাবলাম আমার নর্থপোল ক্রস করার অভিজ্ঞতা শেয়ার করলে মন্দ হয়না।
ইউএস এর শিকাগোতে এসেছি একদিন হোল। শীতের প্রকোপ বেড়েছে। এখানকার ঠাণ্ডা প্রায় অসহনীয়। দুই তিন লেয়ার করে সোয়েটার জ্যাকেট মাফলার গরম টুপি পরলেও হাড়ের ভিতরে ঠাণ্ডা গিয়ে লাগে। বেশিক্ষন বাইরে থাকা নিরাপদ নয়। স্নো পড়ে চারিদিকে একেবারে ধবধবে সাদা। যে হোটেলে উঠলাম ওটা থেকে মাত্র তিনশ মিটার সামনেই বেশ বড় এক সুপারমার্কেট। মেইন রাস্তা ক্রস করে যেতে হয়। স্নো র মধ্যে রাস্তা পেরোনো একটু চিন্তার বিষয়। মার্কেটে ঢুকে মনে হোল বেশিরভাগ কর্মচারীই মেক্সিকান। ফুড সেকশনে বিশাল যজ্ঞ। কেবল সালাদ বারে রয়েছে কমপক্ষে তিরিশটি আইটেম। স্যুপ কাউনটারে ছয় রকমের সুপ দেখলাম। হট ফুডের ছড়াছড়ি। মানুষ দেদারসে ফুডবক্সে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী খাবার নিচ্ছে। তিন সাইজের বক্স রাখা। যা খুশি নিতে পারি। সবকিছু এভারেজ ওজন করে প্রাইস ট্যাগ লাগিয়ে দিচ্ছে। ঝামেলাহিন সোজা হিসাব। এতে সময় বাচে।
শপিং শেষ।হাতের ব্যাগ ভারী হয়ে গেছে। স্নো ফল আবারো শুরু হয়েছে। ফুটপাথে একফুটের বেশি স্নো। যতবার স্টেপ দিচ্ছি মনে হয় চোরা বালিতে পা ডুবে যাচ্ছে। ভাবছিলাম নর্থপোল নিয়ে মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুটা কোথায়। সত্যিকারের নর্থ পোলের অবস্থান আর্কটিক মহাসাগরের মাঝে। ওখানে মানুষ বসবাস করার কথা চিন্তাই করতে পারেনা। সাগরের পানি বলতে গেলে সবসময় বরফে ঢাকা থাকে। তবে এর কাছাকাছি ক্যানাডার নুনাভুট টেরিটরি রয়েছে। নর্থ পোলের আশেপাশে বেশি লোকজন নেই। নিকটতম এলাকায় মাত্র হাজার তিনেক মানুষের অধিবাস।
রাস্তা পার হতে বেশ সময় লেগে গেল। এমন বরফাচ্ছিদ রাস্তাতে গাড়ী চালানো বেশ ট্রিকি। ব্রেকের উপরে ভরসা করা যায় না। মোটামুটি ফাঁকা না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা ভাল। পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে রাস্তা পেরোনো বিপদজনক। ঠাণ্ডায় একেবারে কাহিল। কিছুতেই শীত মানছেনা। রুমে গিয়ে গরম পানি দিয়ে আচ্ছা মতো শাওয়ার নিতে হবে। বের হবার সময় বাইরের তাপমাত্রা মাইনাস এগারো ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড দেখাচ্ছিল।এখানে ফারেনহাইটে তাপমাত্রা বলে যা কিনা বারো ডিগ্রীর মতো। রাস্তা পার হবার সময় বাতাসের ঝাপটায় মনে হচ্ছিল তাপমাত্রা মাইনাস বিশ ডিগ্রী। পাপড়িগুলো ভারী লাগছে। চোখের স্বাভাবিক ময়েসচার জমে বুঝি বরফ হয়ে গেছে। এমন ঠাণ্ডায় মুখে হাত দেয়া ঠিক না। স্কিনের ক্ষতি হতে পারে। আর একটু সামনে গেলেই হোটেলের লবি। পার্ক করা গাড়িগুলো বরফে ঢেকে আছে।
নর্থপোল কোনো দেশের মধ্যে পড়েনি। রাশিয়া ২০০৭ সালে ওখানে গিয়ে সী বেডে তাদের একটি টাইটানিয়াম ফ্ল্যাগ গেড়ে দিয়ে আসে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে সর্বপ্রথম আমি বোয়িং বিমান নিয়ে নর্থ পোলের উপর দিয়ে উড়ে যাই। সে এক নতুন অভিজ্ঞতা। আর্কটিক রিজিয়ন নিয়ে যতটুকুই জেনেছি তাতেই অবাক হয়েছি। বিশেষ করে পোলের উপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় মনে হয়েছিল আমি সত্যিই ভাগ্যবানদের একজন যে কিনা এমন বিরল দৃশ্য স্বচক্ষে দেখতে পেল।


 মহাসাগরের মাঝে মনে হচ্ছিল খণ্ডখণ্ড বরফের পাহাড়ে নর্থ পোলের স্থান লুকিয়ে আছে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সূর্যের আলোতে নীল পানির মাঝে ধবধবে সাদা বরফের মেলা। আর্কটিক টার্ন নামের ছোট্ট পাখি তাই বুঝি এই অপার সুন্দরের লীলাভুমিকে বেছে নিয়েছিল তাদের বংশ বিস্তারের ক্ষেত্র হিসাবে। এই পাখি সৃষ্টির এক অপূর্ব নিদর্শন। ধবধবে সাদা গায়ের রঙের মাঝে লাল ঠোট আর লাল রঙের পা। মাথায় কালো ছোপ। গড় ওজন মাত্র একশ গ্রাম। এরা প্রতি বছরে দলবেঁধে নর্থপোল থেকে সাউথপোল রাউণ্ডট্রিপ দেয়। এভারেজ দূরত্ব অতিক্রম করে প্রায় ছাপ্পান্ন হাজার মাইল। তাদের গড় আয়ু তিরিশ বছর। এই সময়টায় আনুমানিক পনর লক্ষ মাইল ট্র্যাভেল করে। বেশ কবার চাঁদে গিয়ে আসা যাওয়ার সমান দূরত্ব । জীবিত প্রানিদের মাঝে এরাই একমাত্র সবচেয়ে বেশি দিনের আলো দেখতে পায়।


।। আর্কটিক টার্ন ।। 
নর্থ পোলের উপর দিয়ে উড়ে যেতে হলে একটি এয়ারলাইন্সকে তার এয়ারক্রাফটের জন্য বিশেষ অনুমতিপত্র নিতে হয়। হাজারো নিয়মকানুনের বাধা পেরিয়ে তাদেরকে এমন সার্টিফিকেট পেতে হয়। এর মধ্যে পাইলটদের নর্থ পোলের জন্য বিশেষ ট্রেনিং নিতে হয়। এ বিশ্বে খুব কম বৈমানিক আছে যাদের ভাগ্যে এমন প্রশিক্ষণ ও সুযোগ মিলে চাক্ষুষ নর্থপোল দেখার।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে রাওনা করেছিলাম। গন্তব্য আমেরিকার লসএঞ্জেলেস সিটি। বাতাস অনুকুলে না থাকায় এই পোলার রুট নিতে হয়েছিল। তারপরেও ষোল ঘণ্টার জার্নি। সচরাচর আমরা উত্তর পশ্চিমমুখী হয়ে ক্রমাগত পশ্চিম আর পশ্চিম দক্ষিনমুখী উড়ে চলি। পৃথিবীর কারভেচারকে অনুসরণ করে যতটা সম্ভব বাতাসের প্রতিকূলতা কাটিয়ে সময় বাচাতে চেষ্টা করি। তবে ঐ দিন বাতাশের তীব্রতা অধিক হওয়ায় নর্থ পোলের উপর দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনের অনুমতি পাওয়া গেল। যেকোনো এয়ারক্রাফটকে এই রুট দেয়া হয়না। নির্ধারিত বিমানই এ পথে ফ্লাই করতে পারবে। এই বিমানগুলোর আলাদা ছাড়পত্র রয়েছে। নরওয়ে ছাড়িয়ে নর্থপোল টপকে অনেক সময় ধরে ক্যানাডার উত্তর আকাশে উড়তে হোল। এরপর ভ্যাঙ্কুভারকে হাতের ডানে ফেলে অ্যামেরিকার সিয়াটল প্রদক্ষিন করে লসএঞ্জেলেস।
হোটেলের লবিতে এসে উষ্ণ তাপমাত্রায় আরামবোধ করলাম। কোন ম্যাসেজ আছে কিনা রিসেপশনে দেখে নিলাম। রুমে এসে গোসল সেরে ফুডবক্স থেকে খাবার বের করে দেখি বেশ গরম আছে। বাইরের প্রচণ্ড ঠাণ্ডাতে ফুডবক্স ম্যাজিক দেখাল। শেফস্পেশাল ভেজিটেবলসূপ মিক্সগার্ডেন সালাদ সাথে কডফিশ ফিলের ডিনার বেশ ভালো লাগলো। এসময়ে বেশিরভাগ হোটেলেই সংক্ষিপ্ত আকারের ফুড মেন্যু থাকে। পছন্দের খাবার সচরাচর পাওয়া যায়না। তাছাড়া খাবারগুলো অনেক আগে বানিয়ে রাখে।


খাবার শেষে আইপেডে কিছু টেকনিক্যাল নোট ব্রাউয করছিলাম। পরবর্তী ফ্লাইটের প্রস্তুতি নেয়া। এটা রুটিন হয়ে গেছে। পোলার রুটের মতো এক্সট্রা প্রেশার নেই। পোলার রুটের সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হচ্ছে জেট ফুয়েলের তাপমাত্রা নিয়ে। যদি পোলার এরিয়াতে বিমান যে উচ্চতায় উড়ছে ওখানের তাপমাত্রায় ফুয়েল তার ফ্রিযিং পয়েন্টে চলে আসে তাহলে ফুয়েল ফ্রিয হয়ে ইঞ্জিনে তেল সরবরাহ করতে পারবেনা। ইঞ্জিন মধ্যাকাশে বন্ধ হলে তার কি পরিনতি তা সহজেই অনুমেয়। ঐ এরিয়াতে আরো সমস্যা হচ্ছে মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর রেডিয়েশনের বিচ্ছুরন। এর একটা পরিমাপক রয়েছে। মানবদেহের জন্য এর মাত্রা কতটুকু পর্যন্ত নিরাপদ তা আমাদেরকে সেন্ট্রাল অপারেশন হতে অনলাইনে পাঠানো হয়। এই ডাটা স্পেস ওয়েদার থেকে সংগ্রহ করা হয়। আর একটা বিষয় পাইলটকে ভাবিয়ে তোলে তা হোল অল্টারনেট এয়ারপোর্টগুলো সাত আটশ মাইল দুরেও হতে পারে। ক্রুদের জন্য পোলারস্যুট বিমানে দেয়া হয়। ব্র্যান্ডের প্রকারভেদে এসব স্যুট মাইনাস বাষট্টি ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডেও শরীরের তাপমাত্রা প্রটেক্ট করতে পারে। গ্রাউণ্ড এরোনটিক্যাল ষ্টেশনের সাথে কমুনিকেশনও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। পোলার এরিয়াতে ঢোকার আগেভাগেই ফ্লাইট কম্পিউটারে ন্যাভিগেশন সিস্টেমে এক্সট্রিম ল্যাটিচিউডের সতর্কবার্তা দেয়া হয়। বিমানের ন্যাভিগেশনের জন্য আমরা যে ম্যাগনেটিক হেডিং ব্যবহার করি তা তখন সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে থাকে। শুধু ট্রুনর্থের ব্যবহার আছে। এখানে অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশ ফ্ল্যাট হয়ে যায়। নর্থপোল হতে সমস্ত দিক হচ্ছে দক্ষিমুখি। অত্যাধুনিক বিমানগুলো জিপিএস এর দ্বারাই ন্যাভিগেশন পরিচালনা করে থাকে। জিপিএস কোন কারনে ফেইল হলে পাইলটকে নির্ধারিত প্রসিজিউর ফলো করে বিমান পরিচালনা করতে হয়।


তারপরেও বলা যায় নিসর্গের এমন রূপ দেখার ভাগ্য কজনার কপালে জোটে। নর্থপোলে সূর্য একবার উদিত হয় সামারে। মার্চে সূর্য উদয় হয়ে অস্ত যায় সেপ্টেম্বরে। এসময় পুরোটাই দিনের আলো থাকে। সেপ্টেম্বর থেকে উইনটার শুরু। চব্বিশ ঘণ্টাই রাত। সূর্যের জন্য অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী ছয়মাস। পৃথিবীতে কজন মানুষের ভাগ্যে নর্থপোল দেখার সুযোগ হয়েছে বলতে পারবোনা। এমন পেশায় না থাকলে আমার পক্ষে এটা কখনো সম্ভব ছিলনা। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়। দিব্যদৃষ্টি দিয়ে নর্থপোল দেখতে পেরেছিলাম।
—————–
29 jan 2021. 

[ সুপ্রিয় পাঠক, নিরাপত্তার কারনে আমার লেখায় অনেক কিছুই লিখতে পারবো না। বিধি নিষেধ! বিভ্রান্ত না হয়ে আর সেটুকু মেনে নিয়ে সাথে থাকবেন—এই আশা মনে রাখছি।]
জানুয়ারি ২০২১।
রেহমান রুদ্র ।।
প্রবাসী বাঙালি বৈমানিক ।
হ্যালো জনতার নিয়মিত লেখক ।। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কবি-রবি ডাকুয়ার বিজয় দিবসের কবিতা ‘বিজয়ের জন্যে’।।

তাল বা খেজুর রসের বিকল্প, গোলফল দিয়ে হতে পারে রস গুড়-রবি ডাকুয়া ।।

কেন আমাদের এমন মাথা নিচু ছবি দেখতে হবে ? মুসা কামাল-সম্পাদক- হ্যালো জনতা .কম ।।