এক্সক্লুসিভ *বৈমানিকের পান্ডুলিপি * ৭ * পুরানো বাড়ি * রেহমান রুদ্র।।

 


এক্সক্লুসিভ *বৈমানিকের পান্ডুলিপি *

* ৭ * 

*পুরানো বাড়ি *

* রেহমান রুদ্র।।

একটি আধুনিক নতুন এয়ারক্রাফটের রেটিং নিচ্ছিলাম। সহজ করে বলতে গেলে এভিএশিনের ভাষায় এয়ারক্রাফট চালানোর যোগ্যতা অর্জনে যে সার্টিফিকেট কতৃপক্ষ বইমানিকদের প্রদান করে ওটাই রেটিং। শরীরের উপর দিয়ে মাস দুয়েকের ধকল গেল। ট্রেনিং শেষ হবার পরে লম্বা ছুটি পেলাম। এটা পাওনা ছুটি। টিকেট আগেভাগেই কিনে রাখা ছিল। মধ্যপ্রাচের ছোট্ট এ শহর থেকে লন্ডন হিথরো বিমানবন্দর। ওখান থেকে স্বল্প যাত্রা বিরতির পর ক্যানাডার টরনটো পিয়ারসন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। ছুটির আমেজে ক্লান্তির চেয়ে যাত্রী হিসাবে ভ্রমনের আনন্দ উপভোগ করছিলাম। ইমিগ্রেশন অফিসারের দুএকটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে ব্যাগেজবেল্টে অপেক্ষার পালা। অনেকসময় পার হওয়ার পরে সুটকেসের দেখা মিলল। কটা কুকুর নিয়ে কাস্টমস কতৃপক্ষ ব্যাগেজ সার্চের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ডগসার্চ থেকে আমিও বাদ পরলামনা।
ঠাণ্ডার প্রকোপ শুরু হয়ে গেছে। যাত্রীদের সুবিধার্থে বিমান ও টার্মিনালের তাপমাত্রা সবসময় কমফোর্টেবল রেঞ্জে থাকে। জার্নিতে হাতে বেশি জিনিস না নিতে চেষ্টা করি। নানাবিধ সিকিওরিটি সার্চে সময় বেশি লাগে। অনেক সময় দেখা যায় ফ্লাইট কানেকশনের জন্য ট্রানযিট টাইম কম থাকে। তখন রীতিমত দৌড়াতে হয় পরবর্তী ফ্লাইট ধরার জন্য। টার্মিনাল ছেড়ে বের হওয়ার আগে স্যুটকেস খুলে ভারী জ্যাকেট পরে নিলাম। ছুটিতে এসে ঠাণ্ডা বাধানোর ইচ্ছে নেই।
ব্যস্ত টার্মিনাল। ট্রলিতে বেগেজ তুলে যাত্রীদের অপেক্ষার স্থানে এসে দাঁড়ালাম। ওখানে প্রাইভেট ট্যাক্সির লোকজন ঘুরে বেড়ায়। অনেকে এয়ারপোর্টে কাউকে ড্রপ করে খালি ফিরে না গিয়ে অন্য যাত্রীর খোঁজে থাকে। কথা হোল তেমন একজনের সাথে। সে বলল গাড়ি পারকিংএ রেখেছে । ফলো করতে বলল। গাড়ির সাইজ দেখে চিন্তায় পড়ে গেলাম। স্পোর্টসকার। বেগেজ কোথায় সেট হবে তা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন। ট্রলি ব্যাগটা তেমন বড় নয়। শেষ পর্যন্ত পেছনের সিটে ঠাসাঠাসি করে রাখা গেল। দুই দরোজার গাড়িতে কি আর করা।
কলিন ওর নাম। এক ফ্রেন্ডকে ড্রপ করতে এসেছিল । বছর দুএক হল ক্যানাডাতে পড়াশুনা করে। সময় পেলে পার্টটাইম কাজে ব্যস্ত থাকে। ইষ্ট ইওরপিয়ান মেয়ে। বেশ হাসিখুশি। গাড়ি চালানোর হাত ভালই। হাইওয়েতে সবাই ছুটছে। একশো বিশ এর উপরে বেশিরভাগ গাড়ির গতি। স্পোর্টস কার হলেও লেইন চেঞ্জে কোন তাড়াহুড়া করছেনা। এ হাইওয়েতে রাশ লেগেই থাকে। তবে কেও থেমে নেই। বিখ্যাত সিএন টাওয়ার আকাশের দিকে চেয়ে আছে। চমৎকার নির্মাণশৈলী। কথা বলতে গিয়ে সময় কেটে গেল। চল্লিশ্ম মিনিটেই একেবারে বাসার সামনে। ক্যাশ পেমেন্ট পেয়ে খুব খুশি। একটি কার্ডে ওর নাম্বার লিখে দিল। যদি আবারো ক্যাবের দরকার হয় ওকে যেন কল করি। সে আসতে না পারলে অন্যজনকে পাঠিয়ে দেবে। স্টুডেন্ট মানুষ হেল্প করলে ক্ষতি কি। বেশিরভাগ স্টুডেন্টই এক্সট্রা ইনকামের জন্য পার্টটাইম জব করে।
বাসায় ঢুকে মনটা ভরে গেল। সেন্টেড ক্যান্ডেলের মিষ্টি গন্ধে ঘর ভরে আছে। মনে হল ছুটির আনন্দ শুরু হয়ে গেছে। লম্বা জার্নির ফিলিংসটা আর নেই। গোসল সেরে ঘণ্টা খানেক ঘুম দেবার প্ল্যান করলাম। সন্ধ্যায় দাওয়াত আছে। এখানে এলে এমনই হয়। একের পর এক অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। বন্ধুবান্ধবদের সাথে সময় কাটাতে বেশ ভাল লাগে। আড্ডা শুরু হলে রাত পেরিয়ে যায়। এটাকেই বুঝি সত্যিকারের ছুটি বলে। কদিন আনন্দে কাটিয়ে আবারো পুরোপুরি কাজে লেগে যাও পূর্ণোদ্দমে। এতে কাজ ভাল হয়।
আজ কেন জানি একটি ঘটনা শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে। ক্যানাডার গ্রেট সিটি টরনটোতে আমাদের তখন প্রথম পদার্পণ হোল। সে সময়ের কথা। বাড়ি খুজছি কেনার জন্য। একটি বাড়ি রেন্ট করে ওখানে উঠেছি। বাড়ির পেছনে বেশ বড় আপেল আর নাশপতির গাছ। শতশত আপেল নাশপতি ঝুলে থাকতো। স্কুলের মাঠ সংলগ্ন বাড়ির দেয়াল। সামনের লনে অনেক ফুলেরগাছ। দু বেডরুমের সুন্দর গোছানো ছোট্ট বাড়ি। ওখানে আসার কমাস পরে খবর পেলাম আমাদের পরিচিত এক ফ্যামিলি ইমিগ্রেশন নিয়ে ক্যানাডা আসছে। ভাইসাহেব দীর্ঘদিন দেশে এভিএশনের সাথে জড়িত ছিলেন। বাড়ি খুজে না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের এখানে উঠতে চাচ্ছেন। উনাদের বললাম কোন অসুবিধা নেই। সবাই মিলে মজা করা যাবে। প্রয়োজন হলে একসাথে বাড়ি খুজব। একসময় উনারা এলেন। ব্যস শুরু হয়ে গেল নানা রকমের প্ল্যান প্রোগ্রাম। উনাদের এক ছেলে এক মেয়ে। আমাদেরও তাই। একসাথে রান্নাবান্না করা লন্ড্রি করা জনপ্রিয় ষ্টোর গুলোতে শপিং করা। আকর্ষণীয় জায়গায় ঘুরে বেড়ানো। এক কথায় চমৎকার সময় কাটছিল। সবকিছু মিলিয়ে এক নতুন জীবনের স্বাদ পাচ্ছিলাম।
এর মধ্যে একটি ঘটনা ঘটলো। ছেলের জন্য সাইকেল কিনেছিলাম। সাইকেল পেয়ে সে মহাখুশি। ওটা নিয়ে বেশ ব্যস্ত। প্রতিদিন ক্লাস শেষে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যায়। কদিন পরে ইস্কুলের ওখানে চালাতে গিয়ে একটি ঢালু জায়গায় পড়ে সাইকেলের হ্যান্ডেল ভেঙ্গে ফেলল। হ্যান্ডেলের নিচের মেইন যে রড থাকে ওটা ভেঙ্গে দুভাগ। ছেলে বেশ ব্যথা পেয়েছিল। আমার ওয়াইফ মলম লাগিয়ে দিয়েছিল যেন ব্যথা বাড়তে না পারে। দুদিনেই ছেলে সুস্থ। কিন্তু নতুন সাইকেলটার কি হবে। সামনে তো পুরোই ভাঙ্গা। রডটা কোথায় পেতে পারি। ছেলের মন খারাপ। কিছু একটা করা দরকার। যেখান থেকে কিনেছি ওটা বেশ নামকরা স্টোর। ওখানে গিয়ে জিজ্ঞেশ করলে হয়তো একটা বিহিত হবে। ওদের কাছে পার্টস থাকতে পারে। কিছু এক্সট্রা টাকা নাহয় গচ্চা গেল।
দুপুরবেলা ভাঙ্গা সাইকেল নিয়ে স্টোরে গেলাম। আমি আর আমার ওয়াইফ দুজনে কাস্টমার সার্ভিস লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভাবছিলাম কি বলব না বলব কিংবা কিভাবে ভাঙল এসবের উত্তর মনের মধ্যে গুছিয়ে নিচ্ছিলাম । কিছু বলার আগেই কাস্টমার সার্ভিসের মেয়েটি এগিয়ে এসে সাইকেলে একটি ষ্টিকার লাগিয়ে দিয়ে বলল র‍্যাকে রাখা সাইকেলগুলোর মধ্যে পছন্দমত যে কোন একটি নিয়ে আসতে। আমরা ঠিক বুঝলামনা ও কি করতে যাচ্ছে। লাইনে আরও মানুষ থাকাতে কথা বাড়ালামনা। ভাবলাম আগে নিয়ে আসি তারপর দেখি কি বলে। দুজনে মিলে একটি পছন্দ করলাম। প্রাইস ট্যাগে দেখি আগেরটির চাইতে দাম একটু বেশি। কিন্তু বেশ সুন্দর। ওটি যখন নিয়ে আসলাম মেয়েটি এসে প্রাইস চেক করে উদ্বৃত্ত যতটুকু ডলার বেশি সেটুকু ক্যাশ কাউনটারে পে করতে বলল। আমরা অবাক হলাম। একটি প্রশ্ন করলনা। ভাঙল কি করে কি হয়েছে না হয়েছে এমন সচরাচর কমন প্রশ্ন আর কি। কিছুই জিজ্ঞেশ করলনা। জাস্ট রিসিটের নাম্বার নিয়ে কম্পিউটারে দিয়ে দেখল কবে কিনেছি। শপিং করার এ যেন এক নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। মনে হচ্ছিল সাইকেলটি ফ্রি পেলাম।
অতিথিরা বাড়ি খুঁজে পেয়েছেন। বাড়িটি উনাদের মনে ধরেছে। ভাইসাহেবের কাজের জন্য লোকেশনটা পারফেক্ট। দেখার জন্য সেলস এজেন্ট মেইলে ছবি পাঠিয়েছেন। অনলাইনে যা দেখলাম মনে হল বেশ পুরনো ধাঁচের বাড়ি। যেহেতু পছন্দ করে ফেলেছেন তখন আর কি বলবো। কদিন সবার সাথে বেশ আনন্দ ফুর্তি হোল। ওনারা বাড়িতে শিফট করার পরে আমাদের বললেন ওখানে গিয়ে দুএকদিন থাকতে। একটি বাড়িতে উঠে নুন্নতম গোছগাছ করতেই অনেক সময় লেগে যায়। বেশ পরিশ্রমের কাজ। ধোয়ামোছা নিয়ে কদিন পার হয়ে যাবে। আমার স্ত্রী বলল বাড়িটাও দেখা হবে আর আমরা গেলে উনাদেরও বেশ হেল্প হবে। আইডিয়াটা খারাপ না। যাবার প্রস্তুতি নিতে কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিলাম।
রাতে ছেলের সাইকেলটি গাড়ির পেছনে ক্লাম্পের সাথে ঝুলিয়ে দিলাম। সকালের একটা কাজ কমে গেল। ওখানে যাবার ডাইরেকশন ভাবী পাঠিয়ে দিলেন। ভোরে উঠে টোস্ট এগ আর কড়া এক কাপ চা। এটাই যথেষ্ট। রাওনা হবার আগে দেখি সাইকেলটি নেই। কি ব্যাপার। বাড়ীর লনের মধ্যে কে আসবে। এটা প্রাইভেট প্রপার্টি। সকালে যাতে কুইক বের হতে পারি তাই গাড়িটি ড্রাইভ থ্রুতে রেখেছিলাম। ছেলে নিশ্চয় সকালে উঠে চালিয়েছে। কিন্তু ও আমার পরে ঘুম থেকে উঠেছে। তারপরেও মনে হল গিয়ে জিজ্ঞেস করি। ঘরে ঢুকে দেখি উনি কর্ণফ্লেক্স আর ব্যানানা নিয়ে ব্যস্ত। সাইকেল কোথায় জিজ্ঞেস করাতে জানালো ও নাকি কাল থেকে সাইকেল ধরেনি। তাহলে গাড়ি থেকে খুলল কে। পরে দেখি ওটা বেকইয়ার্ডের দেয়ালের সাথে কাত করে রাখা। কিছুই বুঝলাম না। ছেলের মা বলল ও ঘর থেকে বের হয়নি। তাহলে ওটা কে ওখানে রেখেছে। আমার স্ত্রীর ধারনা ওটা আমি আদৌ গাড়িতে তুলিনি। যাই হোক আর মাথা না ঘামিয়ে সবাই রাওনা দিলাম।
টরনটো পিয়ারসন এয়ারপোর্টের কিছুদুর আগেই হাইওয়ে থেকে এক্সিট নিতে হোল । চমৎকার শান্তশিষ্ট এলাকা। সব বাড়িঘরই অনেক আগের বানানো বুঝা যায়। অজস্র গাছের সমারোহ। এর মধ্যে রাস্তাগুলো একেবেকে গেছে। যতটুক শুনতে পেলাম এখানে যাদের বাড়ি তা সবই পঞ্চাশ ষাট বছর পুরনো। গত আটচল্লিশ বছরে এই প্রথম কেও বাড়ি বিক্রি করল। অর্থাৎ উনারাই প্রথম এত বছর পরে ওখানে বাড়ি কিনলেন। আর একটি জিনিস লক্ষ্য করলাম এলাকায় ঢোকার মুখেই বিশাল এক চার্চ। এতবড় চার্চ সচরাচর চোখে পড়েনা। সাইড রোড দিয়ে যাবার মুখে অদ্ভুত একটি গাছ দেখতে পেলাম। কেমন যেন ঝাঁকড়া চুলের মানুষের প্রতিবিম্ব। এ জাতীয় গাছ টরনটোতে কোথাও দেখিনি।
শীতের দিন বলে এরই মধ্যে সূর্যটা গাছের পেছনে কেমন নিষ্প্রভ হয়ে আছে। কি অদ্ভুত সব ভাবছি। এসবের কোন মানে হয়না। জোর করে বেড়ানোর মুড ফিরিয়ে আনলাম। জেনেছিলাম বাড়িতে যে কাপল থাকতো তাদের বয়স নব্বুই পেরিয়ে গিয়েছিল। ভদ্রলোক মারা যাওয়ার পরে একা বাড়ীতে থাকা সম্ভব ছিলনা তাই ভদ্রলোকের স্ত্রী এটা বিক্রি করে দিয়ে এপার্টমেন্টে মুভ করেছে । এই বয়সে এপার্টমেন্টে থাকা নিরাপদ ও সুবিধাজনক।
বাড়ীতে ঢুকতেই উনারা আগ্রহ নিয়ে বাড়ীর সবকিছু দেখালেন। তারপর সবাই মিলে চা কফি নিয়ে বসে গেলাম জমজমাট আড্ডায়। বাচ্চারা নিজেদের মতো করে খেলতে চলে গেল। নানা রকম প্ল্যান হচ্ছিলো। কি ভাবে রেনোভেট করা যায় তা নিয়ে আলাপ আলোচনায় মশগুল থাকলাম।

হবে এটা নিশ্চিত। নিচে বেইযমেনটের ফ্লোর পুরাটাই চেঞ্জ করতে হবে। অনেক পুরনো হাল। ওখানে একটি স্টাডিরুম দেখলাম। বইপত্র আর ম্যাগাজিন সব এদিকওদিক ছড়িয়ে আছে। ওটার এন্ট্রিডোর ভাঙ্গা। দরজাটি ওয়ালের সাথে কাত করে রাখা। মনে হয়না কেও ফিক্স করার চেষ্টা করেছে। বয়সের সাথে মানুষের চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন আসে। জীবনে চাওয়া পাওয়া থেকে মানুষ নিজেকে গুটিয়ে আনতে থাকে। অনেক প্রিয় জিনিষ ছেড়ে যেতে হয়।
একটি বেশ পুরনো পেইন্টিং দেয়ালে। এ বাড়ীর যিনি মারা গেছেন তার তরুন বয়সের ছবির পেইন্টিং । মাথায় ওয়েস্টার্ন হ্যাট পরা। পেইন্টিংটি নজর কাড়ে। বেইযমেনটে একটি বেডরুম তার পাশে এক টয়লেট। খেয়াল করলাম বেডরুমটির উপরের ওয়ালে লম্বালম্বি কাঁচের জানালা রয়েছে এতে করে লনের একটি সাইড দেখা যায়। রুমটা বদ্ধ মনে হয়না। তাছাড়া দিনের আলো প্রবেশ করতে পারবে। আইডিয়াটা ভালো লাগলো। মেইন ফ্লোরে লিভিং এরিয়া আর ডাইনিং এর মাঝখানে খুব সুন্দর ডিজাইন করা ঘোলাটে এক কাঁচের পার্টিশান। ওখানে আঁকা কিছু মানুষের প্রতিচ্ছবি আর মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেনটের নকশা। জানতে পেলাম কাঁচটি পঞ্চাশ বছর আগে ইজিপ্ট থেকে ইমপোর্ট করা হয়েছিল। তখন এটা আনতে ভদ্রলোকের বিশহাজার ডলার খরচ হয়েছিল। ঘোলাটে কাঁচের ভেতরে ছবিগুলোতে কেমন যেন আদি রহস্য লুকিয়ে আছে। বেইযমেনটে পরে থাকা কিছু মিউজিক্যাল ইন্সট্রুম্যানট চোখে পড়লো। জানলাম বাড়িওয়ালা ওগুলো বাজাতেন। ভদ্রমহিলা যাবার সময় গিফট করে গেছেন।
রাতে খাবার শেষে গানের আসর বসলো। একেবারে ঘরোয়া অনুষ্ঠান। উনারা জানেন আমার ওয়াইফ গান করে। কোন অজুহাত টিকলোনা। সবাই মিলে ধরলে না গেয়ে কি পারা যায়। অনেকগুলো গান সে গাইল। সংগীতের পর্ব শেষে প্ল্যান করলাম কে কোথায় ঘুমাবে। আমরা দুজন আর ছেলে মিলে বেইযমেনটে বেডরুমে থাকতে পারব। মেইন ফ্লোরের মাষ্টার বেডরুমে উনারা দুজন আর ছেলে থাকবে। অন্য গেস্টরুমে মেয়েরা থাকবে। সারাদিন অনেক হৈচৈ হোল সবাই ক্লান্ত।
ঘুমটা চোখের পাপড়ি ছোঁয়ার আগে বিছানায় শুয়ে কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। কিছুটা আকাশও দেখা যাচ্ছিল। এ বাড়ীটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে বেকইয়ার্ড। ম্যাপেল গাছগুলো মনে প্রশান্তি আনে। ভালই লাগছিল দেখতে। চোখে ঘুম ছুইছুই করছে। হটাৎ মনে হোল কে যেন জানালার পাশ থেকে সরে গেলো। ভাবলাম চোখের ভুল হতে পারে। হয়তোবা রাকুন। ক্যনাডাতে অনেক রাকুন থাকে। এগুলো দেখতে অনেকটা বেড়ালের মতো তবে বেশ বড়সড় হয়। মুখটা ছোট আর ধুসর কালচে গায়ের রঙ। খাবারের খোঁজে রাতেই এদের বিচরন। গারবেজ বিন যদি খোলা পায় তবে প্লাস্টিক ব্যাগ ছিঁড়ে একেবারে যাতা করে আবর্জনা খেয়ে চলে যায়।



গাছের পাতাগুলো বাতাসে বেশ নড়ছে। রাতে বৃষ্টি এলে ঠাণ্ডার প্রকোপটা বাড়বে। কম্ফটারটা গায়ে পেচিয়ে নিলাম। ততক্ষনে বউ আর ছেলে ঘুমের রাজ্যে। আবার কি দেখলাম। সাইকেল নিয়ে কে যেন জানালার পাশ দিয়ে চলে গেল। ছেলে আমার পাশেই শুয়ে আছে। কে সাইকেল চালাবে। এমন ঠাণ্ডায় ব্যাকইয়ার্ডে কারো আসার কথা না। মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। পুরনো বাড়ীর কাঠের ফ্লোর তাই ঘরের তাপমাত্রা বদলানোর সাথে কুটকাট শব্দ করছে। সুনসান নিরবতায় এধরনের শব্দে কেমন যেন গা ছমছম করে। আমাদের অভ্যাস আবছা আলোতে ঘুমানো। বাথরুমের লাইট জালানোই ছিল। এবার দরোজা খোলার আওয়াজে ঘুম ছুটে গেল। কে যেন বাথরুমে ঢুকেছে। শব্দটা ওদিক থেকেই এলো। একটু অবাক হলাম। উপরে দুটি বাথরুম আছে নিচে কে আসবে। এই বেইযম্যানটে কেবল আমরা। আবারো শব্দ হওয়াতে দেখি হুইল চেয়ারে বসা একটি লোক বাথরুম থেকে বেরিয়ে স্টাডিরুমে ঢুকে গেল। এটা কি হোল ঠিক বুঝলামনা। এই বাড়িতে হুইলচেয়ারের কোন মানুষ নেই। শরীর ভারী হয়ে এলো। মনে হোল কে যেন বিছানায় চেপে ধরে রেখেছে। গলা দিয়ে শব্দ বের করতে পারছিনা। অনেক চেষ্টা করে পাশ ফিরে আমার ওয়াইফকে ডাকার চেষ্টা করলাম। ছেলে আর ও দুজনেই ঘুমে অচেতন। শেষমেশ ঘুম ভাঙ্গাতে পারলাম। বললাম তুমি কি কোন শব্দ শূনতে পেয়েছ। দেখলাম এক লোক হুইল চেয়ারে বসা স্টাডি রুমের দিকে চলে গেল। সে তো মহা বিরক্ত। ভাবল আমি স্বপ্ন দেখেছি। পাত্তাই দিলনা। বলল কি উল্টাপাল্টা কথা বলছ। ইচ্ছে হলে তুমি গিয়ে দেখে আস। আমার ঘুম পাচ্ছে ঘুমাতে দাওতো । এই বলে দিব্যি ঘুমিয়ে গেল। কি আশ্চর্য আমি নিজে দেখলাম হুইলচেয়ারের লোকটি স্টাডি রুমে ঢুকল। ভারী শরীরটা বিছানা থেকে টেনে তুললাম। আমাকে দেখতে হবে ঐ পড়ার রুমটাতে কেউ আছে কিনা। যখন ওখানে গেলাম কাউকে পেলামনা। এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছুই চোখে পড়লনা। ফিরে আসতে যাব এমন সময় পেছনে শব্দ করে কি যেন পড়ল। সেই ভদ্রলোকের পেইন্টিং । দেয়াল থেকে খশে পড়েছে। কি অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটছে। মনে হচ্ছে কোন হরর মুভি দেখছি। এমন কি কারন ঘটলো যাতে করে ওই মুহূর্তে পেইন্টিঙটি দেয়াল থেকে পড়ে যেতে পারে। মাথায় আর কিছুই ঢুকছিলনা। কি ঘটছে এসব নাকি আমি স্লিপ ওয়াক করছি। তা হবে কেন। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমার স্ত্রী আর ছেলে বিছনায় ঘুমিয়ে আছে। বেডরুমে ফিরে এলাম। শরীরে কেমন যেন এক ফিলিং। হাত পা আড়স্ব হয়ে আছে। ভাবলাম ওয়াইফকে আবারো ডাকবো কিনা। না থাক ডেকে কি লাভ। আমার ঘুম নষ্ট হয়েছে হোক। ওর ঘুম নষ্ট করতে ইচ্ছে হলনা। সব চিন্তা বাদ দিয়ে মনের উপর জোর খাটিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করলাম।
পরদিন সকালে সবার কথাবার্তা শুনে ঘুম ভাঙল। সব্বনাশ অনেক দেরি করে ফেললাম। বাচ্চারা বসে নাস্তার টেবিলে কথা বলছে। হাতমুখ ধুয়ে উপরে গেলাম। কিচেনে ভাবী ব্রেকফাস্টের আয়োজন করছে। আমার স্ত্রীও রয়েছে। হেল্প করছে। বাচ্চাদের খিদে আর সহ্য হচ্ছেনা মনে হল। বারান্দায় সাইকেলটি কাত করে রাখা। কাল রাতের বিষয়টি কি ভাবে তুলবো তা নিয়ে চিন্তা করছিলাম। উনারা যদি ব্যাপারটা অন্যভাবে নেয় তাহলে বেকায়দায় পড়ে যাব। দেখলাম সকাল বেলাতেই ভাইজান বেইযমেনট থেকে ফ্লোর ক্লীন করার যাবতীয় যা আছে তাই নিয়ে এসেছে। মনে হল নাস্তার আগেই কাজে লেগে গেলেন। বাহ বেশ ভাল। কিন্তু সারপ্রাইয তখনও অপেক্ষা করছিল। সে পঞ্চাশ বছরের পুরনো ইজিপশিয়ান কাঁচটি কে যেন ভেঙ্গে ফেলেছে। ওখানে গিয়ে দেখলাম সত্যিই তাই। একদম ভাঙ্গা। খুব খারাপ লাগলো। এমন চমৎকার একটি জিনিষ ভেঙ্গে গেল। আমরাও এলাম আর এমন বিচ্ছিরি এক ব্যাপার ঘটে গেল। হাতুড়ি দিয়ে কে যেন আঘাত করেছে গ্লাসে। কাঁচটির বেশ কয়েক জায়গায় শক্ত কিছুর আঘাতের চিহ্ন। ফ্লোরে কাঁচ ছড়িয়ে আছে। তখন আমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা শেয়ার না করে পারলামনা।

বেইযমেনটে গতরাতে যাকিছু ঘটেছে সবিস্তারে খুলে বললাম। সবার অবাক করা চোখের দিকে তাকিয়ে একই কথা বারবার বলতে হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। নিজে দেখেছি হুইলচেয়ারে করে একটি লোক বাথরুম থেকে বের হয়ে স্টাডিরুমে ঢুকে যেতে। তাছাড়া পেইন্টিংটা ওয়াল থেকে তক্ষুনি পরে গেল কি করে। একথা শেষ করতে না করতে ভাই ভাবি বাচ্চারা সবাই মিলে দৌড়ে বেইযমেনটের স্টাডি রুমে গিয়ে দেখি সত্যিই পেইন্টিংটা ফ্লোরে । সবাই এই প্রথম চিন্তায় পড়ে গেল কিন্তু হুইলচেয়ারে বসা লোকটির বিষয়ে কেও কোন ব্যাখ্যা দিতে পারলনা। সবার ধারনা আমি স্বপ্ন দেখেছি। এসব ঘটনা যুক্তি দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। কখন কোথায় কাদের অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায় তা কে বলতে পারে।

5th feb 2021.

[ সুপ্রিয় পাঠক, নিরাপত্তার কারনে আমার লেখায় অনেক কিছুই লিখতে পারবো না। বিধি নিষেধ! বিভ্রান্ত না হয়ে আর সেটুকু মেনে নিয়ে সাথে থাকবেন—এই আশা মনে রাখছি।]
জানুয়ারি ২০২১।
রেহমান রুদ্র ।।
প্রবাসী বাঙালি বৈমানিক ।
হ্যালো জনতার নিয়মিত লেখক ।। 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কবি-রবি ডাকুয়ার বিজয় দিবসের কবিতা ‘বিজয়ের জন্যে’।।

তাল বা খেজুর রসের বিকল্প, গোলফল দিয়ে হতে পারে রস গুড়-রবি ডাকুয়া ।।

কেন আমাদের এমন মাথা নিচু ছবি দেখতে হবে ? মুসা কামাল-সম্পাদক- হ্যালো জনতা .কম ।।