এক্সক্লুসিভ**বৈমানিকের পান্ডুলিপি * ৩** আশঙ্কা ** রেহমান রুদ্র।।

 

এক্সক্লুসিভ**বৈমানিকের পান্ডুলিপি * ৩*

* আশঙ্কা ** 

রেহমান রুদ্র।।







ছোটবেলার বন্ধু কাইহান। দীর্ঘদিন ধরে নিউইয়র্কে থাকে। তার স্ত্রী রাহেলা ও একমাত্র মেয়ে নিরবধি। ফ্লাইট নিয়ে আসবো শুনে অনেক খুশি। ফোনে কদিন ধরে অজস্র কথা হল। রাহেলা কি রান্না করবে সে মেনু মুখস্ত হয়ে গেছে। অনেকদিন পর দেখা হবে। স্বাভাবিক ভাবেই উভয় পক্ষের আগ্রহ অভিন্ন। এবারের যাত্রা জার্মানির শহর মিউনিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক। মিউনিকের আবহাওয়া বেশ চমৎকার। পনেরো ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। আজ বৃষ্টি নেই। এর আগে যতবার এসেছি বৃষ্টি লেগেই ছিল। একবার শুরু হলে রেহাই নেই। ঝিরঝির করে সারাক্ষণ ঝরতেই থাকবে। সকালের কুয়াশা ভেদ করে পাচ কিলোমিটার হাঁটলাম। হোটেল লবিতে এক্সপ্রেস ব্রেকফাস্ট পাওয়া যায়। দুষ্ট ভাইরাসটার কারনে রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়া নিষেধ। অমলেট আর হেশব্রাউন সাথে ফ্রেশ অরেঞ্জ জুস আর কাপুচিনো। এটাই আজকের এক্সপ্রেস মেনু। লবির টিভি স্ক্রীনে আবহাওয়ার খবর। নিউ ইয়র্কে তুষার ঝড়ের সমূহ সম্ভাবনা। এ ধরনের আবহাওয়ায় ফ্লাই করার জন্য অনেক টেকনিকেল নলেজের প্রয়োজন হয়। বলা যেতে পারে পাইলটকে বেশ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয়। রাতে এখান থেকে নিউইয়র্ক যাত্রা শুরু করবো।
সন্ধ্যায় মিউনিক শহরকে বিদায় জানালাম। উত্তর অ্যাটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের ইষ্টকোস্টে পৌঁছে গেলাম। ল্যান্ডিং এর বেশ আগে থেকে নিউইয়র্কের আবহাওয়া মনিটর করছিলাম। অবস্থা সুখকর নয়। তুষারপাত শুরু হয়েছে। ঝড় শুরুর আগেই বিমানকে ল্যান্ড করাতে হবে। চারিদিকে ধবধবে সাদা বরফের আচ্ছাদন মাটিকে ঢেকে দিয়েছে। পাইলটের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা না থাকলে এমন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় এসব রানওয়েতে বিমান পরিচালনের ছাড়পত্র দেয়া হয়না। লংআইল্যান্ডকে একপাশে রেখে বিশাল যন্ত্রদানব রানওয়ায়ের খোজে ভুমির এক বিশেষ রেডিও ইলকট্রনিক সিগন্যালকে কেপচার করছে। বিমানের চাকা ভুমি স্পর্শ হওয়ার সাথে সাথেই নিরাপদ গতিতে আনার জন্য হাতগুলো বিভিন্ন সুইচ স্পর্শ করে গেল। এমন পিচ্ছিল রানওয়েতে ভুল করার স্কোপ নেই।
এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলের পথে ভারী তুষারপাতের পাল্লায় পড়লাম।
বন্ধুর বাসায় যাবার প্ল্যানটা একদম মাটি। রুমে এসে সবার আগে কাইহানকে কল দিলাম। বেচারার কি যে অবস্থা। ঠাণ্ডায় একেবারে কাহিল। কথা বলতে গিয়ে কাশছিল। ওর গাড়ীটি বরফে আটকে গেছে।


ইমারজেন্সি সার্ভিস কল করেছে কিন্তু এমন ওয়েদারে কি যে হবে কে জানে। টিভিটা অন করতেই দেখি শহরের অবস্থা সংকটাপন্ন। কি আর করা রুমসার্ভিসে ডিনারের অর্ডার করে গোসলে চলে গেলাম। বন্ধু ও তার স্ত্রীর জন্য খারাপ লাগছে। বেচারি কত আগ্রহ নিয়ে রান্নাবান্না করেছে।
পরদিন কাইহান জানালো রাতে গাড়িটি রাস্তার উপরে ছেড়ে আসতে হয়েছে। সার্ভিসট্রাক এসে আজ ওঁটাকে নিয়ে যাবে। নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটনে চেইন স্টোর ডুয়েনরীডে কিছু অত্যাবশ্যকীয় জিনিস কেনার ছিল। স্পেসিফিক আইটেমগুলো এখানে পাওয়া যায়। লম্বা শপিং লিস্ট কোন কাজে এলো না । সারাদিন হোটেল বন্দি হয়ে থাকলাম। শিডিউল অনুযায়ী রাতেই আবার এখান থেকে সরাসরি মধ্যপ্রাচে যেতে হবে। বন্ধুর সাথে বুঝি এবারো দেখা হলনা।

একটানা ফ্লাইট। নিউইয়র্ক থেকে মাত্র টেকঅফ করেছি। রাডারে বিশাল ওয়েদার দেখে ডান দিকে এয়ারক্র্যাফটের দিক পরিবর্তন করলাম। ওদিকটা মোটামুটি নিরাপদ। কিছুদুর যেতেই রাডার কন্ট্রোলের নির্দেশে কানাডার সাথে যোগাযোগ করতে বলল। আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবেশ করতেই ঝাকুনি শুরু । বাতাসের গতিবেগ হটাৎ করে তীব্র হলে এমন হয়। মাটি থেকে হাজারো ফুট উঁচুতে আবহাওয়া বিজ্ঞানের কত উপাদান ছড়িয়ে আছে তা সত্যিই আশ্চর্যের। পাইলটকে পরিপূর্ণ ভাবে এ নিয়ে পড়াশুনা করতে হয়। শতশত মাইল জুড়ে বাতাসের তীব্র গতিবেগের বলয়ে অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে। অজ্ঞানতার কারনে বিপদ হতে পারে। এভিএশনের ভাষায় এটাকে জেটস্ট্রিম বলে। এর সহায়তায় বিমান অসম্ভব দ্রুত গতিতে বাতাসের অনুকুলে উড়ে যেতে পারে। তবে ওর মধ্যে ঢুকতে গিয়ে যথেষ্ট ঝাকুনি খেতে হয়। এই জেটস্ট্রিম সচরাচর পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে ধাবিত হয়। রাত পেরিয়ে দিন হল। স্বচ্ছ নীল আকাশে মহাসাগরের উপরে আমাদের ঠিক নিচ দিয়ে অন্যদিক থেকে আসা একটি বিমান উড়ে গেল।

আটলান্টিক ক্রস করে আয়ারল্যান্ড তার পর বেলজিয়াম অস্ট্রিয়া রুমানিয়াকে বায়ে রেখে তুর্কীর আকাশে বেশ কিছুক্ষণ থাকতে হয়। এরপর ইরাক কুয়েত পেরিয়ে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম।
এরাইভেল এর যাবতীয় কাজ গুলো শেষ করতে মধ্যরাত পেরিয়ে গেল। ফ্লাইট ডিসপাচ এরিয়াতে রাখা কম্পুটারে দ্রুত চেকআউট করে সরাসরি পারকিং লট। ঠাণ্ডায় গাড়ি জমে আছে। হাইওয়ে উঠে গাড়ির গতি একশ করে ক্রুজ কন্ট্রোলে দিয়ে মিউজিক ছেড়ে দিলাম। লম্বা জার্নি তার উপরে খিদেটা বেশ ফিল করছি। আরবদেশগুলোতে মেডিটেরেনিয়ান বারবিকিউ অসাধারণ। রাত দুটো পর্যন্ত খোলা থাকবে। কভিড উনিশের রাজত্ব তাই টেকওয়ে সার্ভিস।
খাবার শেষ করে হজমের কথা ভেবে নেটফ্লিক্সে থ্রিলার সিরিজ নিয়ে জমে গেলাম। মাঝে মাঝে গায়ে কাটা দিয়ে উঠছিল। কিভাবে এমন জীবন্ত মুভি বানাতে পারে। রাত প্রায় দুটা বাজে। ঘুমাবার আগে ডেটল দিয়ে ঘরের ফ্লোর সুইপ করলাম। এটাও কভিড উনিশের ধকল। অভ্যাস হয়ে গেছে। কষ্ট হয়না । সকালে উঠতে দেরি হতে পারে তাই আগেভাগে সেরে ফেললাম।
রিভলভিং ফ্যানের হাল্কা বাতাসে ঘুমাতে ভাল লাগে। ঠাণ্ডার দিনেও একই অভ্যাস। ঘুমিয়ে পরেছিলাম। থ্রিলার সিরিজের কিছু ক্যারেকটার স্বপ্নের মাঝে এসে ঘুমের বারোটা বাজাল। বিছানা ছেড়ে বোতল থেকে ঢেলে পুরো একগ্লাস পানি খেয়ে ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে আবারো ঘুমিয়ে পরলাম। এবারের স্বপ্নটা আরও অদ্ভুত। আমি আর কাইহান চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বীচে হাঁটছি। স্কুল জীবনের কিছু সৃতি নিয়ে হাসছিলাম। কোত্থেকে এক ট্রাক এসে আমাদেরকে প্রায় মাড়িয়ে দিয়ে উধাও হয়ে গেল। মাঝেসাজে স্বপ্ন দেখি কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সকালে উঠে আর মনে করতে পারিনা কি দেখেছি। এই স্বপ্নটা এত জীবন্ত ছিল যা ঘুম থেকে উঠে পুরটাই মনে করতে পারছিলাম। অস্বস্তিকর অনুভুতিতে মনটা ছেয়ে আছে। কি এক অজানা আশঙ্কা।
কভিডের কারনে ওয়াশরুমে বেশ সময় লাগছে। বারবার হাত ধুতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তোয়ালেতে মুখ মুছে কিচেনে ঢুকে ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছিলাম। চায়ের কাপে মাত্র চুমুক দিয়েছি এমন সময় ল্যানড লাইন ফোনটা বেজে উঠল। মোবাইলের যুগে ফোনটা খুব কম ইউজ হয়। একটু অবাক হলাম। ধরব কি ধরবনা ভাবছি। এবার মোবাইলটা বেজে উঠলো। হ্যালো বলতেই অন্যদিকে এক নারী কণ্ঠের কান্না শুনতে পেলাম। বুকের ভেতরতায় কেমন এক অনুভুতি। বন্ধুর স্ত্রী রাহেলা। কাল রাতে কাইহানের শরীরটা হটাৎ খারাপ হয়ে যায়। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। বরফ মাড়িয়ে এম্বুলেনস আসতে একটু দেরি হয়। প্রিয় বন্ধুটি কভিড উনিশের আর এক ভিকটিম। অক্সিজেন সেচুরেশন লেভেল বিপদজনক ভাবে ড্রপ করেছে। রাহেলা আর নিরবধির কান্নায় আমার সান্ত্বনা দেয়ার শব্দগুলো জড়িয়ে যাচ্ছিল। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগে ওর সাথে কথা হয়েছিল। অদ্ভুত ব্যাপার। ঘাতক ভাইরাসটি কখন ঘাপটি মেরে শরীরের ভেতর বংশ বৃদ্ধি করছিল কে জানে। কাইহান বরাবরই কষ্টসহিষ্ণু প্রকৃতির মানুষ। হয়ত ভেবেছিল তেমন কিছু নয়। রাহেলাকে কি করে সান্ত্বনা দেবো বুঝতে পারছিলামনা। কিই বা বলবো। এর উত্তর জানা নেই।
[ সুপ্রিয় পাঠক, নিরাপত্তার কারনে আমার লেখায় অনেক কিছুই লিখতে পারবো না। বিধি নিষেধ! বিভ্রান্ত না হয়ে আর সেটুকু মেনে নিয়ে সাথে থাকবেন—এই আশা মনে রাখছি।]
জানুয়ারি ২০২১।

রেহমান রুদ্র ।।
প্রবাসী বাঙালি বৈমানিক ।।
হ্যালো জনতার নিয়মিত লেখক ।। 





মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কবি-রবি ডাকুয়ার বিজয় দিবসের কবিতা ‘বিজয়ের জন্যে’।।

তাল বা খেজুর রসের বিকল্প, গোলফল দিয়ে হতে পারে রস গুড়-রবি ডাকুয়া ।।

কেন আমাদের এমন মাথা নিচু ছবি দেখতে হবে ? মুসা কামাল-সম্পাদক- হ্যালো জনতা .কম ।।