এক্সক্লুসিভ**বৈমানিকের পান্ডুলিপি * ৪ **ওরা বুঝে ফেলেছে । ** রেহমান রুদ্র।।

 

এক্সক্লুসিভ**বৈমানিকের পান্ডুলিপি * ৪ *

*ওরা বুঝে ফেলেছে । *

* রেহমান রুদ্র।।


মনোবিজ্ঞানের উপরে লেখা একটা জার্নাল পড়ছিলাম। মগজের নিম্নাংশে রয়েছে ইমশনাল সেনটার। মানব মনের কত রহস্য লুকিয়ে আছে এখানে তা অবাক করার মত। নানান বেস্ততার মাঝে দিন কাটছে। সপ্তাখানেক টার্গেট রেখেও জার্নালটি শেষ করতে পারলামনা। বিশেষ করে লম্বা ফ্লাইটের ধকল কাটাতে দিন পেরিয়ে যায়। হাজার হলেও মানুষের শরীর। হটাৎ করে ভ্রমনের ক্লান্তি মুছে ফেলা যায়না। সম্পর্কের টানাপোড়ন নিয়ে গবেষণাগুলো দৃষ্টি কাড়ে। প্রতিটি প্রানের স্পন্দন বাচিয়ে রাখে অজস্র চিন্তার ফল্গুধারা। মস্তিষ্কের ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে নিতে পারলে জীবনটা সহজ হতে পারে। ছোটোখাটো বিষয় এড়িয়ে চললে অনেক কিছু থেকে রেহাই পাওয়া যায়। হৃদয় পরিমাপ করা সম্ভব নয়। জীবনকে কিভাবে সুন্দর করা যায় তা নিয়ে ভাবাটাই সমীচীন। ক্ষমা মহৎ গুণ কথাটির মর্মার্থ উপলদ্ধি করা যায়।
পাশের বাসায় নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। ফ্ল্যাটটা অনেক দিন খালি পড়েছিল। এই ফ্লোরে আর কেও থাকেনা। সুনসান নীরবতায় ভালই দিন কাটছিল। এমন শান্ত পরিবেশে সাহিত্য নিয়ে ভাবনা চিন্তার ব্যাঘাত ঘটেনা। এই কাপলটা আসার পর থেকে রাত বাড়লে মিউজিকের সাথে হাসির শব্দও বাড়তে থাকে। করিডোরে বের হলে শীশার তীব্র গন্ধ নাকে এসে লাগে। কিছুদিন যেতে না যেতে কাঁচের প্লেট ভাঙ্গার শব্দ শুরু হোল। এ বড্ড যন্ত্রণাদায়ক। কাজের গুরুত্তের কারনে ঘুমটা জরুরী। ভাবছিলাম কি করা যায়। শেষমেশ ওদের সাথে পরিচিত হয়ে কায়দা করে বুঝিয়ে দিলাম রাতের বেলা ঘুমানোর অসুবিধার কথা। যে বুঝবার তার জন্য এটাই যথেষ্ট। পড়শি হিশাবে ভদ্রতা বজায় রেখে যতটুকু বলা যায় তাই বললাম। কিসের কি। রাগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ মানুষ যুক্তি বোঝেনা । প্লেট ভাঙ্গার সাথে চিৎকার চেচামেচি বাড়তি যোগ হোল।
একটা বিষয়ে কথা না বলে পারছিনা। বাসার স্টাডি রুমে জানালার কার্নিশে আজ বহুদিন ধরে দুটো কবুতর থাকে। মলয় আর মল্লিকা। নামগুলো আমি দিয়েছি। ওদের সব গতিবিধি আমার জানা। খুব সকালে ওরা ঘুম থেকে উঠে। মাঝে সাজে উড়ে যায় তবে সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসে । বেশিরভাগ গবেষক একমত এয়ারক্রাফটের মত কবুতর তার মস্তিষ্কের জাইরস্কপ দিয়ে সঠিক ভাবে দিক নির্ণয় করে যার দরুন নিজের আবাসস্থল চিনতে কষ্ট হয়না। যে কোন বিমানে জাইরস্কপ হচ্ছে দিক নির্দেশনার অত্যাবশ্যকীয় ইন্সট্রুমেণ্ট। এটা ওরিয়েন্টেশন আর এঙ্গুলার ভেলোসিটির পরিমাপক। গত কমাস ধরে মলয় মল্লিকার রুটিন বদলে গেছে। বেশির ভাগ সময় এখানেই থাকে। জানালার একদম কাছে পড়ার টেবিল থেকে মাত্র দুহাত সামনে বসে আড্ডা দেয় । চাইলে ওদের ধরতে পারি ভয়ে পালায়না। আগে যখন পড়তে টেবিলের কাছে আসতাম ওরা উড়ে গিয়ে কার্নিশে গিয়ে বসতো। এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। কেন জানি ভয়কে জয় করে ফেলেছে। ফ্ল্যাটের বারান্দা ওদের দখলে। অধিকার হারিয়েছি। স্লাইডিং ডোর খুলে ওখানে যেতে চাইলে কেমন করে যেন তাকায়। ইচ্ছে হয়না পায়রা গুলোর শান্তি বিনষ্ট করি। কবুতরের শব্দ মস্তিস্কের চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটায় না। বাকুম বাকুম ভাবগম্ভির আলাপ শুনতে ভালই লাগে। কি কথা হয় ওদের মধ্যে বোঝা মুশকিল। অবাকের বিষয় হচ্ছে রাতে কক্ষনো যন্ত্রণা দেয়না। একদম লক্ষ্মী। হাল্কা ডানা ঝাপটানোর শব্দ সহনীয়। বাইরের আলোতে দেখতে পারি খুব গলাগলি করে ঘুমিয়ে থাকে।আমার উপস্থিতি নিয়ে ওদের মাথা ব্যথা নেই।
একদিন অবাক করা ঘটনা ঘটলো। সন্ধ্যার পরই ডিউটি। লাঞ্চ করে আরামসে ঘুম দিলাম। পায়রা গুলোর ননস্টপ ডানা ঝাপটানির শব্দে ঘুম ছুটে গেল। ব্যাপার কি এমন তো কখনো হয়না। উৎসুক হয়ে পর্দা সরিয়ে দেখি অচেনা এক কবুতর এসেছে। ওটার গলাতে সাদাকালো বুটিবুটি দাগ। তার সাথে মল্লযুদ্ধ চলছে। একসময় বুটিওয়ালা না পেরে চম্পট দিল। মলয় আর মল্লিকা বাসার সামনে ফোয়ারার দিকে উড়ে গেল। মনে হয় দুজনে রেগে আছে। কেউ কারো কাছে আসছেনা। বাহ এদেরও তাহলে অভিমান বোধ কাজ করে। ডিউটি শেষ করে পরদিন বাসা এসে দেখি একই অবস্থা। ভীষণ হাসি পাচ্ছিলো। ভাবছিলাম কবে এ পর্বের অবসান হবে। কদিন পর বারান্দায় জোরালো গম্ভীর আওয়াজ শুনে দেখি দুটার ঝামেলা চুকে গেছে। গলাগলি আর বাকুম বাকুমে বেস্ত। যাক বাচা গেল। শান্তিতে ঘুমাতে পারবো। এ তো গেল কবুতর কাহিনি কিন্তু এর সাথে যোগ হয়েছে বিড়াল বিষয়ক জটিলতা।

গ্যারেজের পারকিং এ একটা বিড়াল সবসময় জ্বালাত। এই যেমন গাড়ির বনেটে উঠে হিশি করে দেয়া কিংবা টায়ারের উপরে নখের আঁচড় কাটা এসব। আমাকে দেখলেই দৌড়ে পালিয়ে যায়। এখন শীতের সময় গাড়ির সামনের দিকে ইঞ্জিনের ঠিক নিচে আরামসে রাত পার করে দেয়। কিছুদিন হল কোত্থেকে যেন এসেছে আর এদিক ওদিক ঘুরঘুর করে। একবার বেশ বকা খেয়েছিল। ফ্লাইট করে এসেছি। ক্লান্ত শরীর। উনি দেখি আমার ফ্ল্যাটের দরজার পাশে রাখা ফুলের গাছের পাশে দিব্যি বসে আছেন। বললাম সরে যেতে কিন্তু গা করলনা। হাতে ব্যাগ আর সুটকেস। ধাক্কা লাগতে পারে । বকা খেয়ে দৌড়ে পালালো। এরপর থেকে আমাকে চোখে চোখে রাখে। প্রথম যেদিন কভিডের কারনে মাস্ক পরা দেখেছিল সে তো অবাক। ভ্রু কুচকে চোখগুলো আরও ছোট করে বুঝবার চেষ্টা করছিল সমস্যাটা কোথায়।
নতুন বছর। ঘড়ির কাটা বারোটা পেরিয়ে গেছে। জরুরি একটা কল করার কথা। গোসল সেরে ফোন হাতে নিতেই পাশের ফ্ল্যাট থেকে হৈচৈ শোনা গেল। সেই দম্পতি। মধ্যরাতে কি শুরু হোল। আজ থার্টি ফাস্ট নাইট। কভিডের মধ্যেও ছোটখাটো অনুষ্ঠান আয়োজনে বেস্ত মানুষ। সমস্যাটা কোথায় বুঝতে পারছিনা। কথার তীব্রতা বেড়ে চলেছে থামবার কোন ল্পক্ষন নেই । মনে হচ্ছে এভাবে রাত পার করে দেবে । বাধ্য হয়ে দরোজায় নক করাতে ক্ষান্ত হোল।
সকালে বারান্দায় গিয়ে দেখি কবুতর দুটো এক সাথে বসে আছে। কিছু শস্য ছিটিয়ে দিলাম। শীতের সকাল বাইরে তখনও কুয়াশার প্রলেপ। বছরের প্রথম দিনে লম্বা হাটবার প্ল্যান করে বেরিয়ে পড়লাম। গালফ এর পাড়ে খেজুর গাছগুলো সারীবদ্ধভাবে দাড়িয়ে নোনা জলের গন্ধ নিচ্ছে। সুন্দর নিরছিন্ন পরিবেশ। হাঁটছি আর কবুতর দুটোর কথা ভাবছি। ওদের মান অভিমান আছে কিন্তু কি সুন্দর মিলেমিশে থাকে।

অনেক্ষন হোল এবার ফেরা দরকার। পারকিং লটে গাড়ি রেখে লিফট বরাবর এগুচ্ছি। লিফট থেকে পড়শি তরুন দম্পতি বেরিয়ে এলো। চমৎকার সাজগোছ। চেহারাতে বিন্দুমাত্র রাতের ঘটনার কোন রেশ চোখে পড়লোনা। পারফিউমের গন্ধ মাস্কের ভেতর দিয়ে নাকে এসে লাগলো। নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করলাম।
আজকাল পরিবেশ পরিস্থিতি বদলে গেছে। আমার প্রতি বিড়াল আর কবুতরের সহানুভূতির কারন জেনে গেছি। মাস্ক পরে যখন গাড়ির দিকে যাই বিড়ালটি গাড়িতে না উঠা পর্যন্ত কাছ ঘেঁষে হাটে। কোনোরকম ভয়ডর নেই। কেমন যেন মায়া তার চোখের ভাষাতে। কবুতর আর বিড়াল ভয়কে জয় করে ফেলেছে।
ওরা বুঝে ফেলেছে এক অদৃশ্য ভাইরাস এর কারনে আমি আজ অসহায়।
[ সুপ্রিয় পাঠক, নিরাপত্তার কারনে আমার লেখায় অনেক কিছুই লিখতে পারবো না। বিধি নিষেধ! বিভ্রান্ত না হয়ে আর সেটুকু মেনে নিয়ে সাথে থাকবেন—এই আশা মনে রাখছি।]
জানুয়ারি ২০২১।
রেহমান রুদ্র ।।
প্রবাসী বাঙালি বৈমানিক ।
হ্যালো জনতার নিয়মিত লেখক ।। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কবি-রবি ডাকুয়ার বিজয় দিবসের কবিতা ‘বিজয়ের জন্যে’।।

তাল বা খেজুর রসের বিকল্প, গোলফল দিয়ে হতে পারে রস গুড়-রবি ডাকুয়া ।।

কেন আমাদের এমন মাথা নিচু ছবি দেখতে হবে ? মুসা কামাল-সম্পাদক- হ্যালো জনতা .কম ।।