‘১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১, ব্ল্যাকআউটের ঘুটঘুটে আঁধার রাত’।। দেওয়ান মাবুদ আহমেদ ।।

 ## A hellojanata.com Presentation. 



‘১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১, ব্ল্যাকআউটের ঘুটঘুটে আঁধার রাত’-

 দেওয়ান মাবুদ আহমেদ ।।


১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১, ব্ল্যাকআউটের ঘুটঘুটে আঁধার রাত। সাড়ে এগারো কি প্রায় বারোটা, পুরো ঘর অন্ধকার, আলো বের হয় কি হয়না টিমটিম করে জীবনটাকে কোনোমতে বাঁচিয়ে রেখেছে একটি হারিকেন। কোনোরকমে ছায়া-কায়ার আভাসে প্রতিদিনের মতো অল্প আওয়াজের মধ্যমণি ট্রানজিস্টার ঘিরে চারমাথা এক করে বড়ভাই, তুষার’দা, আরো দু’জন স্বাধীন বাংলা বেতার শুনছিলেন।
www. hellojanata.com
হঠাৎ তাদের কেউ একজন “জয় বাংলা” বলে চিৎকার করতেই অপর একজন তৎক্ষণাৎ মুখ চেপে থামিয়ে দিলো। শুরু হলো ফিসফাস “স্যারেন্ডার করতে রাজী হয়েছে”। ফিসফাসের আওয়াজ একটু বাড়তেই ‘কোন দিক থেকে কোন বিপদ আসে’ আতংকে আম্মা ছুটে এসে সবাইকে থামিয়ে দিলেন।
সেদিন সেসময় কেন জানি জেগে ছিলাম। বড়দের ফিসফাসের উত্তেজনা সংক্রমিত হয়েছে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ুয়া ছোট্ট এই প্রাণেও। আম্মা জোর করে নিয়ে শুইয়ে দিলেও ভোরসকালে উঠার একটা তাগিদ সুপ্তমনে রয়ে গেলো।
ভোরেই উঠলাম। ততক্ষনে আকাশ আলোয় উদ্ভাসিত হতে শুরু করে দিয়েছে। বড়ভাইরা সারারাত ঘুমিয়েছিলেন কিনা জানিনা। তবে তাদের মধ্যে আনন্দে ফেটে পরার একটা চাপা উত্তেজনা বেশ বুঝতে পারছিলাম। পরিস্থিতি ও বিপদ আশঙ্কায় নিজেদের দমিয়ে রেখেছেন, চেহারায় স্পষ্ট। কেউ একজন ঘর থেকে বেরিয়ে আশপাশের পরিস্থিতি দেখে আসতে চাইছেন। কিন্ত আম্মার নিষেধে পারছেনও না।
আম্মা ততক্ষনে নাস্তার আয়োজনে ব্যস্ত। আমরাও একজন দু’জন নাস্তা খেয়ে নিলাম।
সকাল সাড়ে সাতটা-আটটার দিকে ৭/৮ জনের একদল মুক্তিযোদ্ধা বুক চিতিয়ে খোলা রাস্তা দিয়ে এসে ঘর সম্মুখের টিন দরোজায় ধাক্কা দিলো। আম্মা আঁতকে উঠে বড়ভাইদের বাহিরের পায়খানার দিকে পাঠিয়ে নিজে গেলেন দরোজা খুলতে।
দরোজা খুলতেই “জয় বাংলা” চিৎকারে আগত মুক্তিযোদ্ধারা আম্মার পা ধরে সালাম করতে করতে “খালাম্মা দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে”, “আমরা জিতে গেছি”, “আর কোনো ভয় নাই” কলরবে মেতে উঠতে বড়ভাইরা সব বেরিয়ে আসলেন।
“বসো নাস্তা করবে” বলে আম্মা আবার গিয়ে ঢুকলেন রান্না ঘরে।
বড়ভাই অষ্টম শ্রেণী থেকে রাজনীতিতে জড়িয়ে পরেন। নিউমার্কেট এরিয়া ছিল তখন শহরের প্রানকেন্দ্র। বড়ভাইয়ের স্কুল ছিলো নিউমার্কেট ঘেষা। সিটি কলেজও আমাদের বাসার একেবারে কাছেই। সেসময় থেকেই বড়ভাইয়ের বন্ধুরা ঘরে আসতেন প্রায়শই। ১৯৭০ সালের ভয়াল ঘূর্নিঝড়ে বড়ভাইদের হাতিয়ায় চালানো ত্রান তৎপরতার কেন্দ্রও ছিলো আমাদের ঘর। বড়ভাইদের বন্ধুদের নিরাপদ একটা আশ্রয় ছিলেন আম্মা, সবার খালাম্মা।
নির্বাচনের পর অসহযোগ আন্দোলনে এলাকার মহিলাদের সাথে আম্মাও মিছিল, মিটিংয়ে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। ছিলেন শেল্টার মাস্টার।
১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সকাল থেকেই শুরু হলো মুক্তিযোদ্ধাদের খালাম্মাকে সালাম করতে আসা। কতোক্ষন পর পর একটা একটা দল আসে। কোনো কোনো দলের সাথে ছিলো ভারতীয় সৈন্য। টানা তিনদিন। সামনের টিনের গেট থেকে ঘরের শেষমাথার রান্নাঘর পর্যন্ত এই তিনদিনে ‘মুক্তিযোদ্ধাদের পায়ের ধুলোয়’ মাটির একটা স্তর জমে গিয়েছিলো।
৫০ মিটার দুরে বিহারীদের যে স্কুলে (তৎকালীম ইসলামিয়া স্কুল, বর্তমানে সিটি মহিলা স্কুল) এতোদিন বেলুচ রেজিমেন্ট ছিলো, সেখানে এসে আশ্রয় নিলো মুজিব বাহিনী।
বিজয়ের আনন্দে আপ্লুত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল সেদিন ১৬ ডিসেম্বর আম্মার কাছে আবদার করলেন আমাকে ও আমাদের একমাত্র বোনকে (আমার বছর দেড়েকের বড়) সাথে নিয়ে পুরো শহর আজ সারাদিন ঘুরে বেড়াবেন।
আমরা দু’জন খুঁজে বের করে ভালো কাপড়টা পড়লাম। মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা কোত্থেকে জানি একটা সাদা গাড়ী নিয়ে এসেছিলেন। উনারা ছিলেন চারজন আর আমরা দু’জন।
মাদারবাড়ী হয়ে আগ্রাবাদের দিকে রওয়ানা দিলেন উনারা। পশ্চিম মাদারবাড়ীর একটি ঘরের সামনে থামলো গাড়ী, সহযোদ্ধাদের সাথে দেখা সাক্ষাতে জানলেন পলায়নরত দু’জন রাজাকার ধরা পরেছে। আমাদের রাজাকার দেখাতে নিয়ে গেলেন। রশি দিয়ে হাত বেঁধে লটকিয়ে রাখা হয়েছে দু’জনকে, হালকা মারপিট হয়েছে, একজনের মুখ থেকে একটু রক্ত গড়াতে দেখলাম। দু’জনের একজন পরনে সদ্য লন্ড্রী থেকে আনা সাদা শার্ট-প্যান্ট। সেখান থেকে কমার্স কলেজের কাছে সম্ভবত কবির তোরণ (কিছুদিন আগে প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা গরীবুল্লাহ ভাইদের বাড়ী ছিলো)। ওখানেও মুক্তিযোদ্ধাদের একটা আশ্রয়স্থল ছিলো।
সেখান থেকে বেরিয়ে সল্টগোলা রেলক্রসিং হয়ে নদীর পার ধরে এয়ারপোর্ট (তখন এয়ারপোর্ট, বর্তমান নেভাল যাওয়ার রাস্তা ছিলো সল্টগোলার একটু পর থেকে নদী ঘেঁষে)। নৌ-কমান্ডো ও যৌথবাহিনীর বিমান আক্রমণে বিধ্বস্থ জাহাজ দেখানো হলো আমাদের।
এয়ারপোর্ট ঘুরে সোজা সিআরবি (বর্তমানে শিরীষতলা নামে খ্যাত), রেলওয়ের হেড অফিস। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘাঁটি সিআরবি অফিসে বিমান হামলা হয়েছিলো, ছোঁড়া হয়েছিলো দু’টি বোমা। যে কোনো কারনে সেগুলো বিস্ফোরিত হয়নি। দু’তলার দক্ষিণ পাশের বারান্দায় খুব কাছ থেকে দেখলাম বোমা দু’টিকে।
কাছেই সার্কিট হাউস। নরপশু পাকিস্তানি হানাদারদের আরেকটি নির্যাতন কেন্দ্র। ইলেক্ট্রিক চেয়ারে বসিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হতো মুক্তিকামী মানুষদের।
এখনো স্পষ্ট মনে আছে সার্কিট হাউস মূলভবনের সামনের খোলা জায়গায় মাথার খুলি, নরকঙ্কাল ভর্তি তিনটি গর্ত দেখেছিলাম।
প্রতিটি জায়গায় সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের সাথে নিয়ে নিজেরা পাকিস্তানিদের নৃশংসতার ভয়াবহতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন।
চিকিৎসাধীন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে নিয়ে গেলেন আমাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভীড় সেখানে।
শুধু একজনের কথা মনে আছে। সেসময়কার সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল বশর ভাই। আইস ফ্যাক্টরী রোড যুদ্ধে যিনি তলপেট-বাম পায়ের জয়েন্টে আটটি গুলি খেয়ে মারাত্মক আহতাবস্থায় ধরা পরেন। যে যুদ্ধে শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক।
সন্ধ্যার আগে আগে আমাদের ভাই-বোন দু’জনকে নামিয়ে দিয়ে যান মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা।
সারা শহরের রাস্তায় রাস্তায় স্বাধীন উল্লাসে মেতে উঠা সাধারণ মানুষ উচ্ছাসের পাশাপাশি পাকিস্তানি নরপশুদের অত্যাচার কেন্দ্রগুলোতে
তখনো ফিরে না আসা আপনজনদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা!!

দেওয়ান মাবুদ আহমেদ ।
মুক্তমনা লেখক ।
## লেখাটি আমাদের ব্লগ ও সামাজিক মাধ্যম সমুহে প্রকাশিত ।।
হ্যালো জনতা ডট কম ।।
hellojanata,com

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কবি-রবি ডাকুয়ার বিজয় দিবসের কবিতা ‘বিজয়ের জন্যে’।।

তাল বা খেজুর রসের বিকল্প, গোলফল দিয়ে হতে পারে রস গুড়-রবি ডাকুয়া ।।

কেন আমাদের এমন মাথা নিচু ছবি দেখতে হবে ? মুসা কামাল-সম্পাদক- হ্যালো জনতা .কম ।।