Captain Rudro way-হ্যালো ভ্যালেনটাইন- রেহমান রুদ্র।

 ## A hellojanata.com Presentation 

Captain Rudro way-হ্যালো ভ্যালেনটাইন- রেহমান রুদ্র।


দিল্লীতে এসেছি দিন দুয়েক আগে। সচরাচর এখানে আসা হয়না। প্রফেশনের তাগিদে বেশিরভাগ সময় ইউরোপ, ইউ এস এ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিন আফ্রিকা কিংবা ফারইস্টের দেশগুলোতে যাতায়াতটা বেশি।

বিকেলে বেরিয়েছিলাম কিছু কাপড়-চোপড় কিনতে। আজ তেরই ফেব্রুয়ারি। আগামিকাল “ভ্যালেটাইন-ডে”। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুল কেনার উৎসব দেখলাম কিছুক্ষন। মেইন মার্কেটের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। প্ল্যান ছিল দু জোড়া থ্রি-পিস কেনার। সম্ভব হলনা, পাঁচ জোড়া পছন্দ হল। সব চুড়িদার। কালার চয়েসের মারপ্যাঁচে কনফিউজড হয়ে দোকানিকে বললাম, প্লীজ একটু হোল্ড কর, এক্ষুনি আসছি। নো প্রব্লেম, দোকানি রাজী।সাঁ করে ঢুকলাম ফোন বুথে আর সরাসরি রিং ক্যানাডার টরন্টোতে। সময়ের তারতম্যে প্রিয়তমের গলা আধো ঘুম আধো জাগরণে। জিজ্ঞেস করলাম কোন শেড গুলো নেব। মেরুন, লাল, কলাপাতা সবুজ, নীল। সবকটাই সুন্দর। ও বোঝে পাগলামিটা। প্রশ্ন করল এখন কোথায়। বললাম, চাঁদনী চক। তবে ঢাকার নয়, দিল্লীতে। লাল ওর প্রিয় রঙ, তারপরও জিজ্ঞেস করা। ভালোবাসার মধ্যে স্পাইস জুড়ে দেয়া। হতে পারে হাজারো মাইল দূর থেকে কাছে না পাবার শূন্যতা।




কেনাকাটা শেষ। এখন হোটেল ফিরব। কাল খুব সকালে ফ্লাইট। ফিরে যেতে হবে মদ্ধপ্রাচ্চের আবাসস্থলে। প্রিয়তমাকে বলেছি, ফিরেই কল দেব। ভ্যালেনটাইন ডের গিফট এখন হাতে। অদ্ভুত বিষয়, মনের আঙিনায় দেখতে পেলাম প্রিয়তমার শরীরে কি সুন্দর ড্রেসগুলো মানিয়ে গেছে। ভীষণ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে তাকে। মনের জগতে, ভালবাসার অহমিকা ওকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। গাড়ি হোটেলের মেইন গেইটে নামিয়ে দিল। রিসেপশন দিয়ে যাবার সময় সেতারের মৃদু ক্লাসিক্যাল মিউজিক মনের মাঝে আবহ সৃষ্টি করে।
“ক্যাপ্টেন, হাউ আর ইউ”।
ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম। একই অর্গানাইজেশনের এক মেয়ে। একটু অবাক হলাম। দিল্লী আসার পথে তাকে দেখিনি। ওকে মনে রাখার কারন হচ্ছে, ওর নামটা বেশ রোমান্টিক, অভিমানী। কমাস আগে একটি ফ্লাইটে একই সাথে ডিউটি পড়েছিল। তখন তাকে জিজ্ঞেশ করেছিলাম এ নামটি কে দিয়েছে, নাকি কেবল কর্পোরেট নেইম। বেশ জোর দিয়েই বলেছিল, এটা তার বাবা-মায়ের দেয়া নাম। দিল্লীর মেয়ে। কমার্স গ্র্যাজুয়েট। ভবিষ্যতে মাস-কমুনিক্যাশন নিয়ে পড়াশুনা করার ইচ্ছে আছে।
“হেই, হোয়াটস আপ। গুড টু সি ইউ হিয়ার।“
“কি করছ এখানে, কারো সাথে দেখা করতে এসেছ?”
অবাক হলাম। আমার সাথেই দেখা করতে হোটেল লবিতে অপেক্ষা করছে। কি নাকি জরুরী বিষয়।
“সারপ্রাইজ করলে, কি ব্যাপার তা বলতে পারো”। আশ্বস্ত করলাম তাকে।
ঝাড়া পাঁচ মিনিট অনর্গল কথা বলল অভিমানী ইংরেজি আর হিন্দি মিশিয়ে। একটা বিষয় না বলে পারছিনা। দিল্লী আর মুম্বাইয়ের ছেলেমেয়েরা আজকাল কিছু হিন্দি শব্দকে ইংরেজির সাথে এমন করে মিলিয়ে দেয় যা শুনতে ভালই লাগে। মনে হয় ইংরেজি ভাষাটাকে ব্যবহার করছে হিন্দি ভাষার কারনে। একেবারে স্মুথ, ছন্দপতন নেই।
“ ক্যাপ্টেন, কাল তোমার ফ্লাইটে ব্যাক করতে হবে। এসেছিলাম দু সপ্তাহের এনুয়্যাল লিভ নিয়ে। ছুটি শেষ হবার আরও চারদিন বাকি। কাল একটা বিশেষ কারনে ফিরে যেতে হচ্ছে”।
দিল্লী ফ্লাইট বেশীরভাগ সময় ওভারবুকড থাকে। অভিমানী জানালো প্রায় চল্লিশজন যাত্রী এক্সেস আছে। ওর একটা স্টাফ জাম্পসিট প্রয়োজন। এধরনের সিটগুলোতে স্টাফদের অগ্রাধিকার থাকে তবে তা ক্যাপ্টেনের অবগতি ছাড়া কাউকে দেয়া যাবেনা।
কৌতুক করে বললাম, “নাহ, জাম্প সিট দেয়া যাবেনা। অন্যজনের রিকোয়েস্ট আছে”।

বেচারির চোখমুখ দেখে মায়াই হল। বুঝি এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। অভিমানীর কথায় অভিমানী সূর-
“ কাল ভ্যালেনটাইন ডে। ফিয়াসে অপেক্ষা করে আছে। অনেক প্ল্যান সে করে রেখেছে। প্লীজ, হেল্প মি”।
বুঝলাম, বিষয়টা ইমশনাল, ফান করা ঠিক হবেনা। জানলাম, অনেকবার রুমে ফোন করে না পেয়ে সশরীরে হাজির হয়েছে। প্রায় ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করছে লবিতে।
কথা দিলাম।
ভদ্রতা রক্ষার জন্য লবির কফিশপে আমন্ত্রন জানালাম। ওর চোখমুখ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। রাজি হোল সে। বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে।
মাইকেল আনসারি। লেবাননের ছেলে। মাত্র কমাস আগে তাদের পরিচয়। সে ফীল করছে, ছেলেটি খুব ভালবাসে তাকে। কফি খেতে খেতে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে ট্যাব বের করে মাইকেলের ছবি দেখাল। বেশ হ্যান্ডসাম। দুজনের একসাথে তোলা অনেক ছবি।
মাইকেলের ভালবাসায় হাবুডুবু খাওয়া অভিমানী ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেল। রুমে এসে তাড়াহুড়া করে গোছগাছ করলাম। খাওয়াদাওয়া পর্ব শেষ করে ফ্ল্যাটস্ক্রিনে বিভিন্ন চ্যানেল ঘোরাঘুরি করে ঘুমিয়ে পড়লাম।





ফোনের শব্দে ঘুম ছুটে গেল। ভোর চারটা, কল টাইম। স্বয়ংক্রিয় মেশিনে অদ্ভুত এক সম্ভাষণ,
“গেট আউট অফ দ্য বেড। ইটস এনাদার ডে, গেট আউট অফ দ্য বেড।“ কি অদ্ভুত বাস্তব সম্ভাষণ।
দাঁড়ি ট্রিম, ব্রাশ আর হট শাওয়ার শেষে পরিচ্ছন্ন ইউনিফর্ম।
সময়মত এয়ারপোর্ট এসে হাজির। এয়ারলাইন্সের স্টাফ ফ্লাইট ব্রিফিং এর কাগজপত্র দিয়ে প্যাসেঞ্জার লোড জানালো। ওভার বুকড ফ্লাইট। অভিমানীর স্টাফ আইডি নাম্বার তাকে দিয়ে বললাম, ওকে যেন জাম্পসিটে চেকইন করায়। কাস্টমস, ইমিগ্রেশন সেরে বোর্ডিং লাউঞ্জে অপেক্ষা করছি। এয়ারক্রাফট আসতে আধঘণ্টা বাকি আছে। আবহাওয়া খারাপ তাই ল্যান্ড করতে দেরি হচ্ছে। প্রি-ফ্লাইট ব্রিফিং এ মনোযোগী হলাম।

ঝলমলে এলুমিনিয়াম এলোয়ের এয়ারক্রাফট পারকিং এ ইন করছে। ফ্লাশিং বিকন আর গ্যাংওয়ের লাইটগুলো দেখতে বেশ লাগছে। মনে হচ্ছে সাইন্সফিকশন ছবির পটভূমি।
“হাই”।
তাকিয়ে দেখি, অভিমানী। হাল্কা সবুজ আর মাষ্টারড এর সংমিশ্রণে চমৎকার সালোয়ার কামিজ। সাথে ফ্ল্যাট স্লিপার। নিখুতভাবে সেজেছে। সুন্দর যেন আজ আরও প্রস্ফুটিত হয়েছে। বুঝলাম, ফিয়ান্সে এসে এয়ারপোর্টে রিসিভ করবে।
“অজস্র ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন। তোমার জন্য আজ ট্র্যাভেল করতে পারছি।“
বললাম, “ ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু ম্যানশন, এঞ্জয় দ্য ফ্লাইট”।
কথা শেষ করতে দিলনা মেয়েটি-
“না না। অবশ্যই আজ রাতে আমাদের সাথে ডিনার করবে। ফিয়াসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। প্লীজ, না করোনা।“
আগমনী ফ্লাইটের সব যাত্রী নেমে গেছে। এয়ারক্রাফটে যাবার সময় হল। তাকে তাড়াহুড়ো করে সম্মতি জানিয়ে যাত্রার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হলাম।

অভিমানী সামনের ক্যাবিনের জাম্পসীটে ছিল। যাত্রার মাঝামাঝি সময়ে একবার ককপিট থেকে বেরিয়েছিলাম। ফ্লাইটডেক থেকে বেরুতে দেখে সীট ছেড়ে উঠে এলো।
“ক্যাপ্টেন তোমার সেল নাম্বারটা দাও। প্রোগ্রাম একদম ফিক্সড। সন্ধ্যায় কল দেব।“

ঘরে ফিরে শাওয়ার নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। সময়ের তারতম্ম্যে এখানকার স্থানীয় সময় অনুযায়ী খুব ভোরেই উঠতে হয়েছিল। সময়ের কাঁটা কমিনিট যেতেই ডুবে গেলাম নিশ্চিন্ত পরম শান্তির ঘুমে।
সেলফোনটি কেঁপে কেঁপে উঠছে। সাইড টেবিলে রাখা ফোনটির ভাইব্রেটার ঘড়ঘড় শব্দ করছে। দিন নাকি রাত কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কে ফোন করল। অনেক কষ্টে হাত বাড়ালাম। ফোনের অপরদিক থেকে আসা শব্দে মগজ বুঝি গলে গেল।
“হ্যালো”।
“ হাই ক্যাপ্টেন অভিমানী বলছি, মনে আছে নাকি ভুলে গেছ।“
সবকিছু স্লো মোশানে ধারণার জগতে ফিরছে। অভিমানী। কমিটম্যানট। ডিনারের আমন্ত্রণ। অনেক কথার মাঝে একবার মাইকেলের কথা বলেছিল। ওর ফিয়াসে। অভিমানীর প্রিয় মানুষ।
“সরি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।“

অভিমানী কী সব যেন বলছে। বেচারা মাইকেল অফিসের চাপে বেরুতে পারেনি। স্থানীয় ব্যাংকে কাজ করে, ক্রেডিট কার্ড ডিভিশনে। এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে আসতে পারেনি। সরাসরি ওখান থেকে ডিনারে জয়েন করবে।
কেমন করে যেন সবকিছু ঘটছে। এমন পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়েনি। একেত ভ্যালেনটাইন ডে। ওদের দুজনার মাঝে নিজের ভূমিকা কি হতে পারে তা ঠিক বুঝতে পারছিনা। কিছু বলার সুযোগ পাচ্ছিনা। পরিস্থিতি সে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করছে। অভিমানীর জোরাজুরিতে রাজি হতে হল। ওকে পিক করে “এপলবীয”। রেস্টুরেন্টটি কাছাকাছি, যেতে বেশিক্ষন লাগবেনা। অভিমানীর বাসার ঠিকানা নিলাম। এটাও তেমন দূরে নয়।
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। ক্যানাডাতে প্রিয় মানুষটিকে ফোন দিলাম। রিং বাজছে। অপরপ্রান্তে কেউ নেই। ওখানে এখন সকাল। সম্ভবত কাজে চলে গেছে। কাজ থেকে ফিরলে ম্যাসেজ পাব। ভালবাসা দিবসের শুভেচ্ছা টেক্সট করে দিলাম।

সন্ধ্যা আটটা বাজে। অভিমানীর ফ্ল্যাটের নীচে অপেক্ষা করছি। সিডি তে “বুদ্ধাবার” এর হিপ্নটিক মিউজিক। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এসেছে। অপূর্ব সাজে সেজেছে। ধবধবে সাদা সিল্কের লো-কাট গাউন। পেছনে কোমর পর্যন্ত বেয়াড়াভাবে কাপড়টি নেমে গেছে। গলায় সাদা পাথরের সূক্ষ্ম চেইন। মাথার চুলগুলো উঁচু করে খোঁপা বাধা। তাতে গ্লিটারস দেয়াতে চিকচিক করছে। এমনিতে হাইট পাঁচফুট ছ ইঞ্চির মতো, তার মদ্ধ্যে পেন্সিলহিল। হিন্দি ছবির কোন নায়িকা গাড়ীর দিকে আসছে বুঝি। শুনেছি মেয়েদের দৃষ্টি অনেক প্রখর হয়, কথাটি আজ প্রমাণিত হল। এই আলোআঁধারিতে সে বিস্মিত চোখের ভাষা পড়ে ফেলেছে।
গাড়িতে উঠেই প্রশ্ন,
“আচ্ছা বলত, কেমন লাগছে। মাইকেলের পছন্দ হবে তো।“
সময় ক্ষেপণ না করে বললাম, অবশ্যই করবে। মনে হল বেশ খুশি হয়েছে। বুদ্ধাবারের মিউজিক নিয়ে হাজির হলাম “এপলবিয”। প্রায় ছ ফুটের স্মার্ট মাইকেল অপেক্ষা করছে, হাতে অনেকগুলো তাজাফুল। অভিমানী গাড়ী পার্ক করার সুযোগ দিলনা, দরজা খুলে নেমে পড়ল। ভাগ্য সুপ্রসন্ন, পারকিং পেয়ে গেলাম। দুজনকে বেশ মানিয়েছে। মেইড ফর ইচ-আদার। মাইকেল পরেছে জিন্স আর ফিনফিনে সাদা টি শার্ট সাথে পয়েনটেড শু। হাত বাড়ালাম। অনেক আন্তরিকভাবে গ্রহন করল সে। মনে হচ্ছে অভিমানী আমার বিষয়ে সবকিছু বলেছে, অর্থাৎ ট্র্যাভেলের বিষয়টি। খাবার টেবিলে ওদের ভালোবাসার চাহনি পরিবেশকে আরও মোহনীয় করে তুলল। মাঝেমধ্যে মেয়েটি নিজের প্লেইট থেকে খাবার মাইকেলকে খাইয়ে দিচ্ছে। ভালোবাসায় বুঝি ধর্ম বর্ণ বা সামাজিক ভেদাভেদ নেই। এর বহিপ্রকাশ সাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রানবন্ত। অভিমানী মাইকেলকে “মাই ভ্যালেন্টাইন” বলে সম্বোধন করছিল।

অভিমানী ওয়াশরুমে গেল। মাইকেল প্রশ্ন করে কদিন ধরে আমাদের পরিচয়। সাবলীলভাবেই বললাম, এর আগে একটা ফ্লাইটে দেখা আর গতকাল, ব্যস। মাইকেল অবাক করে দিয়ে বলল, পাইলট তুমি হয়ত জাননা, অভিমানী পাইলটদের অনেক পছন্দ করে। উত্তরে কিছুই বললাম না। অভিমানী ফিরে এসেছে।
খাবারের পর্ব শেষের দিকে। বিদায় নিতে হবে। বললাম, সময়টা ভাল কেটেছে। তোমাদের জীবন সুন্দর হোক। হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে। আনন্দে থাকো। অভিমানীর তীব্র মাথা ঝাঁকুনিতে চুপ করে গেলাম। কিছুতেই যেতে দেবেনা। তার প্ল্যান হোল একসাথে “আমিগো” তে যাবার। এটা শহরের সবচেয়ে ফেমাস ড্যান্স ক্লাব। গতকাল থেকেই সবকিছু যেন মেয়েটি নিয়ন্ত্রণ করছে। মতামত প্রকাশের সুযোগ পেলামনা। ওর এক কথা, তিনজন একসাথে যাচ্ছি “আমিগো” তে। ওকে জানালাম, যাচ্ছি তোমাদের সাথে, তবে বেশিক্ষন থাকতে পারবনা। জরুরী কাজ আছে। এতে সায় দিল সে। ক্যানাডার বিষয়টা জানালাম না।


ক্লাবটি একটু দূরে। মাইকেলের গাড়ীকে ফলো করছিলাম। ওদের ঠিক পেছনে ড্রাইভ করছি। অভিমানীর একটি হাত মাইকেলের কাঁধে। চিরন্তন যুগল দৃশ। গালফের কোল ঘেঁসে করনিসের পথ ধরে এগুচ্ছি। এ সময় রাস্তায় ট্রাফিক থাকে প্রচুর। ওয়েস্ট-বে যাবার আগে বামদিকে টার্ন নিলাম। পরপর তিনটি প্যারালাল রোড পেরিয়ে মাইকেলের গাড়ী ডানের রাস্তায় ঢুকল। এটা রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া। সুন্দর ডিজাইনের ভিলাগুলো সারিবদ্ধভাবে বানানো হয়েছে। এখানে কি করে ক্লাব হবে। চিন্তার ঢেউ না ফুরাতেই সেলফোন বেজে উঠলো।
“এখানে মাইকেলের এক ফ্রেন্ড থাকে, ও কে পিক করে ক্লাবে যাচ্ছি।“

অভিমানীর কণ্ঠস্বর চিন্তাকে আশ্বস্ত করল। প্রায় মিনিট দশেক ঠায় বসে থাকলাম। কাউকে দেখলাম না বাড়ি থেকে বেরুতে। এবার কল দিতে হল, কি হচ্ছে এখানে জানা দরকার। কল রিসিভ হতে শুনতে পেলাম দুজন কি নিয়ে জানি একসাথে কথা বলছে। মাইকেলের গলা বেশ উচুতে।
“এক্ষুনি যাচ্ছি, মাইকেলের ফ্রেন্ড পরে এসে জয়েন করবে।“
অভিমানী বুঝি একটু এম্ব্যারাস হয়ে আছে। এটুকু বলেই লাইন কেটে দিল। ওদের গাড়ীকে আবারো পিছু নিলাম। দশমিনিটেই ক্লাবের পারকিং লটে চলে এলাম। বিশাল এরিয়া। টকটকে লাল নিয়নে লিখা “আমিগো”। পর্তুগীজ শব্দ, অর্থাৎ “বন্ধু”। পারকিং পাওয়া দুষ্কর। বার কয়েক চক্কর দিয়ে পেয়ে গেলাম। মাইকেল আর অভিমানী তখনো ঘুরছে। এস এম এস পাঠালাম, মেইন গেইটে আছি। রঙ্গিন লাইট দিয়ে সাজানো গেইট। অন্তত এক ডজন সিকিউরিটি স্টাফ এন্ট্রির বিষয়টি কন্ট্রোল করছে। ফিমেইল কোম্পানি ছাড়া ঢোকা যাবেনা। অনেক কড়াকড়ি। প্রচুর ছেলে দাড়িয়ে আছে, কানে মোবাইল। মনে হয় পার্টনারকে যোগাযোগ করছে। ঢুকব কি করে জানিনা। ওদের অপেক্ষায় থাকলাম।
দুজন এসে পড়ল। ফাইনালি পার্ক করতে পেরেছে।

“ ঢুকব কি করে বলত।“
প্রশ্ন করাতে সুন্দর এক হাসি উপহার পেলাম।
“ইটস নাথিং”। একটু অপেক্ষা কর, আসছি।“
দুজনে ঢুকে গেল। যেখানে ছিলাম, ওখানেই দাড়িয়ে থাকলাম। ফাইনালি কি হয় তার অপেক্ষায় আছি। বেশিক্ষন দাড়াতে হলনা। সাদা গাউনের উপরে শর্ট ব্ল্যাক পুলওভার পরেছে অভিমানী। ভেতরে বুঝি অনেক ঠাণ্ডা। এই প্রথম হাত ধরল। চল, ভেতরে কেউ আটকাবেনা।

বিউটি হ্যাজ ইটস ওন পাওয়ার। কোন সমস্যা ছাড়া ঢুকে গেলাম। এ এক অদ্ভুত রাজ্য। বিশাল ডিসকোটেক। ফ্লোরে একসাথে শতজনের উপরে ড্যান্স করছে। আলোআঁধারিতে অসংখ্য চেয়ার টেবিল আর সোফা সাজিয়ে রাখা। মেজাজি মাল্টি কালার লাইটিং আর মিউজিক নিমিষেই পার্থিব জগত থেকে স্বপ্নচারী করে তুলেছে।
ড্যান্স ফ্লোরের কাছাকাছি জায়গায় বসলাম। মাইকেল মুখিয়ে ছিল ড্রিংকস এর জন্য। অভিমানী আর মাইকেল শুরু করল “ব্লাডি ম্যারি” দিয়ে। মিউজিক ডি-যে এসেছে ইউরোপ থেকে। চমৎকার সব গানের সিলেকশন। ননস্টপ বেজে চলেছে গানের এ্যালবাম। মাইকেল বেশ কুইকলি প্রথম ড্রিংকটি শেষ করল। বার এরিয়াতে গেল গ্লাস ভরে আনতে।
অভিমানী কি যেন বলল। মিউজিকের শব্দে বুঝতে পারলামনা। একটু ঝুকে বলল-

“জানো, কার জন্য ও বাসার সামনে অপেক্ষা করছিলাম। সামিহা। মাইকেলের এক বন্ধুর ফ্রেন্ড। ওর বন্ধু ফুটবলার। ম্যারেড। এই সামিহা একসময় মাইকেলের গার্লফ্রেন্ড ছিল। এখন সব শেষ। ওরা স্রেফ বন্ধু।“
“ওহ আচ্ছা।“ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম।
মাইকেলের হাতে সেকেন্ড ড্রিংকস। মনে হয় জিন এন্ড টনিক নিয়েছে। জানালো সামিহা আসছে।
ওরা দুজন ফ্লোরে উঠলো। ভালই নাচছে। রিদমিক শরীরে প্রতিটি বীট ধারন করছে। সত্যিই ঈর্ষা করার মত এক কাপল। ফ্লোরে এমুহূর্তে অন্তত ত্রিশটি কাপল কিন্তু মিউজিক ডি-জের দৃষ্টি এখন অভিমানী আর মাইকেলের রিদমিক ড্যান্স। ডি-জে এনাউন্স করলো-
“দিস সং ইজ ডেডিক্যাটেড ফর দ্য লাভ্লি কাপল ইন দ্য কর্নার উইথ হোয়াইট সিল্ক লেডী এন্ড স্মার্ট ব্লু জিন্স।“
ঘামে চকচক করছে মোলায়েম নগ্ন পিঠের আকর্ষণী শরীর। মাইকেলের সাদা টী-শার্ট ভিজে চুর। ওদের ব্রেক দরকার। এখনও সারাটি রাত পড়ে আছে। পরম নিশ্চিন্তে ওদের ড্যান্স দেখছিলাম। মিউজিকের রিদম এখন বদলেছে। আফ্রিকান সঙ্গীতের সুর ডি-জের পছন্দের তালিকায়। ফ্লোর থেকে নেমে দুজনেই ছুটল ওয়াশরুমে। পরিপাটি হওয়া দরকার। নতুন মেকআপ আর একপ্রস্ত পারফিউমের সৌরভে অভিমানী এসে আবারো চুমুক দিল ব্লাডি-মেরীতে।
“তুমি অনেক সুন্দর নাচতে পারো। অবশ্য মাইকেলও যথার্থ।“
কমেন্ট পেয়ে খুশি হল সে। অনেক্ষন হল, মাইকেলের দেখা নেই। কি হল তার। অভিমানী বেশ উচ্ছ্বাস নিয়ে জানালো, মাইকেল আর সে বিয়ে করার প্ল্যান করছে। বিয়ের পরে কোথায় অর্থাৎ কোন দেশে থাকবে তা নিয়ে এখনও ফয়সালা হয়নি।
মাইকেলের সাথে একটি মেয়ে। সম্পূর্ণ কালো পোশাকে সেজেছে। বেশ আকর্ষণী ফিগার। তবে অভিমানীর মত লম্বা নয়। দৃষ্টি অনুসরন করে অভিমানী ঘাড় ফিরাল। সামিহা। উঠে দাঁড়াল অভিমানী সাথে আমিও। পরিচয় পর্ব শেষ হোল। সিরিয়ার মেয়ে। স্থানীয় একটি ব্যাংকে ভাল জব করে। মেয়েটির পারসোনালিটি লক্ষ্য করার মত। মার্জিত ও পরিপাটি সাজ।
ওরা তিনজন কথার মাঝে ডুবে আছে। নির্দিষ্ট কোন প্রসঙ্গ নেই।
অভিমানী প্রশ্ন করে- “ফুটবলার কোথায়?”
সামিহা জানালো আসবে কিনা ঠিক নেই। ফ্যামিলি প্রবলেম।
মিউজিক তার উদ্দামতার ইশারায় ডাকছে। ওরা তিনজন মিলে ফ্লোরে উঠলো। অনুরধ করেছিল নাচার জন্যে। মন সায় দিলনা। ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি।

তিনজন একসাথে নেচে চলেছে। মাইকেল মাঝখানে, সামনে অভিমানী আর পেছনে সামিহা। দুজন সুন্দরীর মাঝে মাইকেলের শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলছে। ফাস্ট মিউজিকের পরে এবার স্লো নাম্বার প্লে করছে। রোমান্টিক সঙ্গীতে ভালোবাসার জ্বর নামে তিনজনের দেহে। অভিমানীর নগ্ন দুহাত মাইকেলের দু কাঁধে শক্ত করে আঁকড়ে আছে। সামিহার হাত আলতো করে পেছন থেকে মাইকেলকে ধরে আছে নাচার তালেতালে। দৃশ্যটি খুব আবেদনময়ি। অভিমানীর মোবাইলে টেক্সট পাঠালাম, তোমরা আনন্দে থাকো। সি ইউ নেক্সট টাইম। আই এম লিভিং নাও, গুড নাইট।“
“আমিগোর” প্রবেশ পথে ঠাণ্ডা বাতাস, এলকোহল আর পারফিউমের উদ্দীপক গন্ধ ফেলে বেরিয়ে পড়লাম। মিউজিকের শব্দ এখনও কানের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বাসায় এসে আবারো শাওয়ার নিতে হল। অনেক্ষন ফোয়ারায় ভিজে কিছুক্ষন পরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ভাবছিলাম, মাইকেল আর অভিমানীর কথা। সুন্দর এক জুটি। ওদের জীবন সুখের হোক। সামিহার কথা মনে এলনা। ক্যানাডায় ফোন করে প্রিয়তমাকে ভ্যালেন্টাইন ডে-র শুভেচ্ছা জানালাম। চোখজুড়ে নামছে ঘুমের প্রহর। কেমন আবেশি ঘুম। শান্তির ঘুম।
মোবাইলের শব্দে বুকটা ধড়ফড় করে উঠলো। কাঁচা ঘুম। চোখ দুটো প্রায় বুজে এসেছিল। টরেন্টো থেকে ফোন আসতে পারে তাই সাইলেন্সে রাখিনি। ফোন রিসিভ করতেই হতভম্ভ হয়ে গেলাম।
অভিমানী কাঁদছে। ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। কি যেন বলছে তখনও বুঝে উঠতে পারিনি।
“কাম ডাউন, কি হয়েছে, কোন এক্সিডেন্ট?”
আবারো একপ্রস্ত কান্না, কিছুতেই থামাতে পারছিনা। এত স্বল্প পরিচয়ের মাঝে কি এমন ঘটে গেল যা তাকে শেয়ার করতে হচ্ছে। তাও আবার লেইট নাইটে। আবারো বললাম কান্না থামাতে।
কিছুটা সময় নিয়ে বলতে শুরু করল কি হয়েছে। বুক হিম করা খবর। বিশ্বাস করা যায়না। কমিটম্যানটের ধারনা কি পাল্টে গেছে। দৈহিক সৌন্দর্য, ভালবাসার অঙ্গীকার এসব একসাথে অস্বীকার করা কি সম্ভব। উত্তরটা জানা নেই। মানুষের চরিত্রে যদি হায়না ভর করে তবে তাকে কি বলা যায়।
ওদের নাচ শেষ হবার পরে মাইকেল আর সামিহা ড্রিংকস এর জন্য বার কাউন্টারের দিকে যায়। অভিমানীর এক কলিগ তার ফ্রেন্ড নিয়ে এসেছিল। হটাত দেখা হওয়াতে আলাপে ডুবে যায় সে। কথার ফাঁকে কত সময় গড়িয়েছে তা বুঝতে পারেনি। সামিহা আর মাইকেলের খোঁজ নেই। দুজনার সেলফোন টেবিলে রাখা। কোথায় গেল বুঝতে পারছেনা।
খোঁজার একপর্যায়ে পারকিং লটে আবিষ্কার করল দুজনকে। মাইকেলের গাড়ীর ব্যাকসীটে দুজন শরীরের বন্যতায় উদ্ভ্রান্ত, তার উপরে পানীয়ের প্রভাব। কোনদিকে হুঁশ নেই তাদের। কি হৃদয় বিদারক, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল অভিমানীর-

“ওহ গড, এ আমি কি দেখলাম। কাকে হৃদয় দিয়েছি। আমার সর্বনাশ সে ……।“
এটুকু বলে আবারো কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। সান্ত্বনা কিভাবে দেব জানিনা। তেমন কোন শব্দ মনে আসছেনা যা দিয়ে এ মুহূর্তে ওর ভেঙ্গে যাওয়া মন আর আত্মবিশ্বাসকে কিছুটা হলেও প্রশমিত করানো যায়। মানুষকে চেনার উপায় কি হতে পারে। ভাললাগা, ভালবাসা, সংসারের স্বপ্ন সব নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল। পরিচ্ছন্ন মুখের অভিব্যক্তির নিচে এধরনের মানুষ আর কি কি অপরাধ লুকিয়ে রাখতে পারে।
গত চব্বিশ ঘণ্টায় যা কিছু ঘটে গেল তার হিসাব মিলাতে পারছিনা। “এপলবিযের” ভালোলাগার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারলে ভাল হত। পরবর্তী ঘটনার রেশ কাটাতে দীর্ঘদিন পেরিয়ে যেতে পারে। বিধাতার ইচ্ছায় এমন অমানবিক বিষয়ের সাক্ষী হয়ে থাকলাম। কানে বাজছে অভিমানীর কান্নাভেজা কণ্ঠ-

“ হি ওয়াজ মাই ভ্যালেন্টাইন। মাই ভ্যালেন্টাইন…………।


রেহমান রুদ্র ।
বাঙালি বৈমানিক ।
নিয়মিত লেখক ।
ছবি -লেখক প্রদত্ত ।
হ্যালো জনতা.কম ।
hellojanata.com ।
হ্যালো জনতার ব্লগ সাবস্ক্রাইব করুন।
hellojanata.com ।

https://hellojanata350.blogspot.com/

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কবি-রবি ডাকুয়ার বিজয় দিবসের কবিতা ‘বিজয়ের জন্যে’।।

তাল বা খেজুর রসের বিকল্প, গোলফল দিয়ে হতে পারে রস গুড়-রবি ডাকুয়া ।।

কেন আমাদের এমন মাথা নিচু ছবি দেখতে হবে ? মুসা কামাল-সম্পাদক- হ্যালো জনতা .কম ।।